'জাল স্বপ্ন স্বপ্নের জাল' গল্পে যে সময়ের ঘটনাপ্রবাহ চিত্রিত হয়েছে তার বিবরণ দাও। অথবা, আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের 'জাল স্বপ্ন স্বপ্নের জাল', গল্পে স্বাধীনতাযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে যে সামাজিক অবক্ষয় দেখা দিয়েছিল তা আলোচনা কর।

আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের জাল স্বপ্ন স্বপ্নের জাল, গল্পে স্বাধীনতাযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে যে সামাজিক অবক্ষয় দেখা দিয়েছিল তা আলোচনা কর।
আধুনিক বাংলাসাহিত্যে আখতারুজ্জামান ইলিয়াস এক রৌদ্রোজ্জ্বল প্রতিভার নাম। বাংলা ছোটগল্পে যে 'রূপকথা-লোলুপতা' ছিল, সেখান থেকে তিনি সরে এসে কর্কশ, তিক্ত, 'ফাঁস-লাগানো' বাস্তবতাকেই গল্পের পর গল্পে উপস্থাপন করে গেছেন। বিষয়ের এই টানে নতুন এক ভাষারীতি ও বর্ণনাভঙ্গিও তিনি আবিষ্কার করে নিয়েছিলেন। এ কারণেই অনেকের কাছেই মনে হতে পারে তার গল্পের ভাষা অশ্লীল, খিস্তিখেউরে ভরা, অমার্জিত, শ্লেষমিশ্রিত। 
মুক্তিযুদ্ধ এবং এর পরবর্তী থেকে বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট মূলত 'জাল স্বপ্ন স্বপ্নের জাল' গল্পের পটভূমি। যুদ্ধের ভিতরে কোনো ব্যক্তির নতুন চেতনায় উত্তরণ নয়, বরং বীরত্বপূর্ণ যুদ্ধ ও মহৎ ত্যাগের বিনিময়ে স্বাধীন হওয়া একটি দেশে স্বাধীনতাপ্রাপ্তির অব্যবহিত কাল পরে কত দ্রুত সর্বস্তরে অবক্ষয় নেমে আসে, আরও পরে কীভাবে তা বিস্তৃতি লাভ করে, প্রতিক্রিয়াশীলরা দ্রুত পুনর্বাসিত ও শক্তিশালী হয়ে কীভাবে চারদিকে ডালপালা-শিকড় ছড়িয়ে বসে, তা-ই এ গল্পের মৌল উপজীব্য। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও ত্যাগকে যেমন ইলিয়াস উপলব্ধি করেছেন, তেমনি বরাবরের মতো এখানেও দেখেছেন মানুষের শঠতা, স্বার্থপরতা, ক্রুরতা ও পশ্চাৎপদতা। 'জাল স্বপ্ন স্বপ্নের জাল' গল্পে ভিন্ন আঙ্গিকে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ তথা স্বাধীনতাপরবর্তীকালের হতাশা, স্বপ্নভঙ্গ, অবক্ষয়, পরাজিত অপশক্তির উত্থান চিহ্নিত হয়েছে; স্বল্পকথায় মুক্তিযুদ্ধের সমকালের নির্যাতন-অত্যাচার, বাড়িঘর- দোকানপাট লুট ও দখলের চিত্র এখানে নিপুণভাবে চিত্রিত। 
'জাল স্বপ্ন স্বপ্নের জাল' আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের অগ্রন্থিত মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গল্প। এ গল্পে এক শহিদের চঞ্চল-নিষেধ অমান্যকারী কিশোর সন্তান বুলেট তার সাহসী লড়াকু পিতার গল্প শুনে শুনে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বিভিন্ন কল্পনা রচনা করে। ওদিকে বুলেট একাধিক ঘাট ঘুরে ঘুরে আশ্রয় ও কাজ পেয়েছে যেখানে তার মালিক পাকিস্তানিদের পক্ষে এক দালাল আবার সমাজে পুনর্বাসিত হয়ে স্বীয় প্রতাপসহ ফিরে এসেছে। তার জন্য একমাত্র অবলম্বন কল্পনা। পিতৃ বন্ধুর মুখ থেকে শোনা গালগল্প, এমনকি অসার স্বাধীনতার কোনো মূল্য খুঁজে পায় না বুলেট। ঘুম ঘোরে প্রস্রাব করে সব ভিজিয়ে দিতে হয় তাকে, বুলেটের প্রস্রাবে ভেজে অতীন্দ্রিয় ভক্তিবাদ, স্বাধীনতার শত্রু, এমনকি জনজীবনে সুফল এনে দিতে ব্যর্থ স্বাধীনতাও। 
বুলেট মুক্তিযোদ্ধার সন্তান হলেও স্বাধীন দেশে যথার্থ উত্তরাধিকার সে বহন করে না। হরতাল মিছিল পিকেটিংয়ে উৎসাহী বুলেট ক্রমে লালমিয়ার মতো স্বপ্ন দেখতে শুরু করে এবং স্বপ্নের কারণ অনুসন্ধানে সে জানতে পারে উল্টো পাওয়ালারা দেশ ও জাতির শত্রু। ফলে সে সঠিক পথের উল্টোদিকে হাঁটা মানুষের প্রতি চরম ঘৃণা প্রকাশ করতে থাকে। কারণ স্বাধীন দেশে শহিদ পরিবারের মাথা গোঁজার ঠাঁই হয় না। তারা রাজাকারের আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়; স্বাধীনতাবিরোধীরা পুনর্বাসিত হয়, মুষ্টিমেয় সুবিধাভোগীর হস্তগত হয় যাবতীয় বিলাসদ্রব্য। নাজির আলি সুবিধাভোগীদের একজন। মুক্তিযুদ্ধের সময় তার দখলিকৃত অনেক বাড়ির মধ্যে কোনটিতে ঘুমাবে তা সে স্থির করতে পারে না। দেশ স্বাধীন হলে নাজির আলি আত্মগোপন করে। দীর্ঘদিন পরে রাজনৈতিক অস্থিতিশীল পরিস্থিতির সুযোগে দেশে পুনর্বাসিত হয়। সুবিধাভোগী নাজির আলিরা অত্যন্ত কৌশলে লক্ষ্যার্জনে নিবিষ্ট। সে বিশ্বাসী লালমিয়াকে দোকানের কাজে লাগায় ও শহিদ সন্তান বুলেটকে আশ্রয় দেয়। তাকে ব্যবহার করে সে স্বাধীন বাংলাদেশে কথিত দেশপ্রেমের আড়ালে অবৈধ পুঁজির মালিক হতে চায়। নাজির আলির স্বগত ভাবনা থেকে তার এ হঠকারিতা ও যুদ্ধপরবর্তী দেশের সম্পদ মুষ্টিমেয় মানুষের কুক্ষিগত হওয়ার কথা জানা যায়: "একটা শহীদ মুক্তিযোদ্ধার ছেলে মানে একটা অ্যাসেট, কখন কী হয় কে জানে? যদি তেড়িবেড়ি করে তখন দেখা যাবে। ঘাপটি মেরে থাকার সময় তখনকার মন্ত্রীর মুক্তিযোদ্ধা ভাইয়ের সঙ্গে ব্যবসা করে যে টাকা করেছে তা কি ব্যাংকে জমাবার জন্যে? গার্মেন্টস চালু হলে তো কথাই নাই। এই মহল্লা কিনে নিতে তখন আর কতক্ষণ?" অথচ মুক্তিযুদ্ধের সময় এ নাজির আলিই ইমামুদ্দিনের মৃত্যুর জন্য দায়ী। তার স্ত্রীকে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হাতে তুলে দেওয়া, বস্তিতে আগুন ধরানো, ইমামুদ্দিনের দাদিকে হত্যা করা প্রভৃতি যাবতীয় কুকর্মের হোতা নাজির আলি। 
বুলেটের বেড়ে ওঠার মধ্যে নীতি বা আদর্শবাদ জাগ্রত হওয়ার সুযোগ না থাকলেও দাদির কাছে পিতার বীরত্বগাথা কথা শুনে অজান্তেই সে হয়ে ওঠে সেসব গল্পের নায়ক। সেনাবাহিনীর লরি কয়েকশ বার উড়িয়ে দিয়ে দালাল নাজির আলিকে গল্পে অন্তত পাঁচশ বার সে হত্যা করে। বলা যায় বুলেটের মধ্যে ইচ্ছাপূরণের আকাঙ্ক্ষা জাগ্রত হয়। লালমিয়া আগে সিনেমার কাহিনি বয়ানে বেশি তৃপ্তি পেলেও ওর যৌবনে তা স্বপ্ন বর্ণনায় পরিবর্তিত হয়। বার বার দেখা সেই স্বপ্নের বিষয়বস্তু একই। অতিবৃদ্ধ কিন্তু নুরানী চেহারার এক মুসল্লি লালমিয়ার সাথে দাঁড়িয়ে নামাজ পড়ে কিন্তু তার পায়ের পাতা সম্মুখবর্তী নয়, পশ্চাৎবর্তী। অর্থাৎ সামনের দিকে হাঁটলেও স্বয়ংক্রিয়ভাবে সে পশ্চাৎগামী হয়।
লালমিয়ার ক্রমাগত এই স্বপ্নবয়ান শোনার ফলে বুলেটের মধ্যেও তা সংক্রামিত হয়। সেও একই স্বপ্ন দেখে এবং তা নিরাময়ের চেষ্টা করে, স্বপ্নেই তাদের পায়ের পশ্চাদমুখিতার কারণ জানতে চায়। তবে যখন বুঝতে পারে স্বপ্নে দেখা মুসল্লি তার আশ্রয়দাতা রাজাকার নাজির আলি, তখন স্বপ্নের ভিতরেই শাস্তি দেওয়ার লক্ষ্যে তাকে লক্ষ্য করে প্রস্রাব নির্গত করে। এখানে স্বপ্নের প্রতীকের আশ্রয়ে লেখক তীক্ষ্ণ বাস্তব সত্যকে প্রকাশ করেছেন।
দেশে প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির পুনর্বাসনে প্রকারান্তরে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষশক্তির অবস্থান সংকুচিত হচ্ছে। এর থেকে পরিত্রাণের প্রধান উপায় প্রতিরোধ। রাষ্ট্রের প্রতিটি মানুষের স্বতন্ত্র ও ভিন্ন অবস্থান থেকে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে স্বকীয় কৌশল অনিবার্য। এ গল্পের বুলেট এই কৌশল অবলম্বন করেছে মাত্র। বুলেট যেন রূপক অর্থে বুলেটই। বুলেটের প্রস্রাবের মুখে কোনো মানুষ লক্ষ্য নয়, লক্ষ্য এক্ষেত্রে পিছনে লাগানো পায়ের পাতা; প্রতিক্রিয়াশীলতা। আর সেই প্রতিক্রিয়াশীলতার প্রকাশ ঘটেছে ইসলামীয় মৌলবাদিদের মধ্য দিয়ে। মুক্তির আদর্শ ও স্বপ্নপূরণে শহিদ হয়েছে হাজারো ইমামুদ্দিন, সেই স্বপ্নকে তছনছ করেছে, মিথ্যা করে তুলেছে প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি, সেই শক্তির বিরুদ্ধে স্বপ্নে কল্পনায় রুখে দাঁড়ায় শহিদপুত্র বুলেট। 
ইসলামের ঐক্য ও সংহতির প্রশ্নে রাজাকাররা; তাদের মতে, পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর প্রতি সহযোগিতার হাত বাড়িয়েছিল। কিন্তু 'কালো হলেও দেখতে ভালো' ইমামুদ্দিনের বউকে কোনো ক্যাম্পে খুঁজে না পেয়ে ইমামুদ্দিনের ভাষায় 'মিলিটারির ভাউরা' আর রাজাকার নাজির আলি ভাবে: "আমার দীনের জন্য হাজার মাইল দূরে থেকে মিলিটারি এসে জান কোরবান করে দিচ্ছে, তাদের শরীরে তো কিছু চাহিদা থাকে। সেটুকু মেটাতে না পারলে নিমকহারামি হয়ে যায় না?" নাজির আলিদের খোলস এভাবে খুলে যায়, তাদের নিষ্ঠুরতা, আদর্শ উদ্দেশ্যের অন্তঃসারশূন্যতা প্রকট ও হাস্যকর হয়ে ওঠে।
মুক্তিযুদ্ধের মহত্ত্ব ও মুক্তিযোদ্ধাদের ত্যাগকে কোনো দিক থেকে খাটো করে ইলিয়াস যুদ্ধপরবর্তী অরাজকতাকে কৌশলে অল্প কথায় তুলে ধরেন এ গল্পে। এ গল্প বর্তমানে শুরু হয়ে পিছনে যায় মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত। মাঝখানের দীর্ঘ ২১ বছরের রাজনৈতিক সামাজিক অবস্থা কতিপয় মানুষের কর্মকান্ড ও ভাবনার মধ্যে উপস্থিতি, যার দ্রষ্টা নিরীহ লালমিয়া। যুদ্ধকালের বর্ণনা টানটান; পাঠক মুহূর্তকাল অমনোযোগী হওয়ার সুযোগ পায় না। যুদ্ধশেষের পর থেকে বর্তমান অবস্থায় আসতে দীর্ঘ পাঁচ পৃষ্ঠার বিবরণে নাজির আলির পুনর্বাসনে প্রকারান্তরে এদেশে স্বাধীনতাবিরোধীদের পুনর্বাসন ও মানুষের স্বপ্নভঙ্গের বিষয়টি স্পষ্ট হয়।
আপনারঅদৃশ্যমন্তব্য
Cancel