"কিশোর 'তিতাস একটি নদীর নাম' উপন্যাসের এক অনন্য চরিত্র।"- উক্তিটি আলোচনা সাপেক্ষে চরিত্রটি বিশ্লেষণ কর
অদ্বৈত মল্লবর্মণের একটি বিখ্যাত উপন্যাস 'তিতাস একটি নদীর নাম'। মালো সম্প্রদায়ের শিক্ষিত সন্তান অদ্বৈত মল্লবর্মণ তার এ উপন্যাসের মধ্যে জেলে সম্প্রদায়ের ক্ষুদ্র খুঁটিনাটি থেকে শুরু করে জন্মমৃত্যু, বিবাহের মতো চরম প্রাকৃতিক বিষয়গুলোও দক্ষতার সঙ্গে তুলে এনেছেন। অন্ত্যজ জীবনের আলেখ্য এ উপন্যাস শুধু ঘটনা লিপিবদ্ধ করার জন্য নয় মালো জীবনের গভীর ও গোপনতম ব্যথা ও বেদনার সুর এ উপন্যাসকে বাংলা সাহিত্যে বিশিষ্ট করে তুলেছে। এ উপন্যাসেরই উল্লেখযোগ্য একটি চরিত্র হলো কিশোর।
'তিতাস একটি নদীর নাম' উপন্যাসের ৪টি পর্ব ও ৮টি উপপর্বের প্রথম অংশ 'তিতাস একটি নদীর নাম' এ অংশে তিতাস নদীর মোহনীয় বর্ণনা তুলে ধরেছেন ঔপন্যাসিক। উপন্যাসের দ্বিতীয় অংশ 'প্রব্যস খন্ড'তেই কিশোরের দেখা মেলে। কিশোর গোকর্ণঘাট গ্রামের রামকেশব মালোর পুত্র। উপন্যাসের প্রথম দিকেই নায়ক বলে ভ্রম হয়। কিশোরের প্রাণচাঞ্চল্য, যৌনচেতনার আবির্ভাব, মানসিক পরিণতির ধাপগুলো লক্ষ করলে মনে হয় যে, কিশোরই হয়তো এ উপন্যাসের নায়ক। কিন্তু কিশোরের এ সক্রিয়তা 'প্রবাস খণ্ডেই' সীমিত। ঔপন্যাসিক যেন জেলে পল্লির ছেলেদের সৌন্দর্য ও মানসিক আবেগের জায়গাটিকে উন্মোচন করতে চেয়েছেন কিশোরের মাধ্যমে। প্রেমিক কিশোর ফুলপাতার সৌন্দর্যে বিমোহিত। যখন-তখন ভাবাবেগে আপ্লুত। অনন্তের মায়ের প্রতি অনুরাগ ও তাঁকে প্রত্যাশা- এসবই প্রেমিক নায়কের সাধারণ লক্ষণ।
কিশোর ছিল অত্যন্ত ডানপিটে ছেলে। সুবলের সাথে ছিল তার গলায় গলায় ভাব। দুজনের কোনো ভয়ডর ছিল না। কেউ কোনো কাজের জন্য ডাকলে উড়ে যায়, মা-বাপ নিষেধ করলেও শোনে না। কিশোর ছিল অত্যন্ত ভালো ও সুবিবেচক। বাসন্তীর মায়ের আহ্বানে কিশোর সুবলকে নিয়ে চৌয়ারি বানিয়ে দেয়। উঠানে আলপনা এঁকে দেয়। বাসন্তীর মা কিশোরকে মনে মনে বাসন্তীর জন্য নির্বাচন করে। কিশোর, বাসন্তী ও সুবলকে ঘিরে কারুণ্যময় যে জীবন তা এখানে আভাসে প্রকাশিত। বাসন্তীর জন্য সুবল কিশোর দুজন মিলে 'চৌয়ারি' বানালেও সুবলকে তার অধিকার ছেড়ে দেওয়া কিশোরের পরিণামী বাস্তবতাকেই ইঙ্গিত করে।
কিশোর দক্ষ তরুণ জেলে। জীবিকার তাগিদে তাকে যেতে হয় উজানিনগরে খলা বাইতে। তিতাসে যখন মাছ পাওয়া যাচ্ছিল না তখন সুবল ও তিলকচাঁদের সাথে সে উজানিনগরের শুকদেবপুরে যায়। এখানেই প্রেমের দেবতা কিশোরের জন্য ফাঁদ পাতে। পঞ্চদশী এক মেয়ের সঙ্গে কিশোরের ভাব হয়। বাঁশিরাম মোড়লের গিন্নি তাদের মালাবদল করিয়ে গান্ধব মতে বিয়ে দেয়। কথা ছিল দেশে গিয়ে ধর্মশাস্ত্রমতে বিয়ে হবে। বাসন্তীর দায়িত্ব দেয় সে সুবলকে। কিন্তু নতুন স্ত্রীকে আবিষ্কার করতে না করতেই তার জীবনে নেমে আসে ভয়াবহ যন্ত্রণার অগ্নিবান। রাতের অন্ধকারে স্ত্রীসহ তাদের মুনাফার দুইশত টাকা নিয়ে যায় ডাকাতেরা। স্ত্রীকে হারিয়ে পাগল হয়ে যায় কিশোর। উপন্যাসের ভাষায়, "রাতের ঝড়ে পাখির সেই
যে ডানা ভাঙ্গিল, সে-ডানা আর জোড়া লাগিল না।"
কিশোর অতি সহজসরল তরুণ। শুকদেবপুরের মোড়লের বাড়িতে আয়োজনের প্রাচুর্য দেখে সে খুব লজ্জিত হয়। মোড়ল যখন বলে, জাল্লা ভাই যা খাইবা কেবল হাতের জোরে। তখন চাতুর্যপূর্ণ ভাষায় সে উত্তর দিতে পারে না। সরল মানুষ হিসেবে সে সরলভাবেই উত্তর দেয়, "আমার দেশে অত বড় মাছ পাওয়া যায় না। বড় মাছ অত বেশি আমরা খুব কম খাই।" কিশোর যেমন সহজ, তেমনি কোমল মনের অধিকারী। সে মানবিক ও সৎ বুদ্ধিসম্পন্ন। শুকদেবপুর গ্রামের নদীর তীরে ধান খেতের ভিতর দিয়ে তিলকচাঁদ মাছ ধরার নৌকা চালিয়ে নিতে গেলে সে ধানগাছের- মধ্য দিয়ে আস্তে যেতে বলে। সে বলে, বাঁশটা আস্তে চালাইও তিলক। যেন ধানগাছ নষ্ট না হয়। কার জানি এই খেত। মনে কষ্ট পাইব। তখন তিলক বলে, "তোমার যত কথা। কত রাখালে পাঁচজনের বাড়ি দিয়া ক্ষেত নষ্ট করে, কত গাই-গরু চোরা-কামড় দিয়া ধান গাছের মাথা ভাঙে, আমরারে চিহ্ন কোন।" এরপর ঔপন্যাসিক কিশোরের শৈল্পিকবোধ সম্পর্কে তুলে ধরেছেন এভাবে-
“তিলকের অর্বাচীনতায় কিশোর চটিয়া উঠিত। কিন্তু এই স্নিগ্ধ সকালবেলার সহিত চটিয়া ওঠা বড় বেমানান। কিশোরের মনের গোপনতায় যে সূক্ষ্ম শিল্পবোধ সবসময় প্রচ্ছন্ন থাকে, তারই ইঙ্গিত এবার তাকে চটিতে দিল না। সে আগেই তীরে নামিয়াছিল। তিলকের ছুড়িয়া ফেলা বাঁশের আগাটা ক্ষিপ্রগতিতে ধরিয়া তার গতিরোধ করিল এবং তার উদ্যত আঘাত হইতে অবেলা ধানগাছগুলিকে বাঁচাইল।”
কিশোর যেমন লাজুক তেমন রুচিশীল। তরুণী মেয়ের সামনে গিয়ে ফুলের নাম জিগ্যেস করতে গিয়ে সে লজ্জায় এতটুকু হয়ে যায়। বেদেনি তাকে মনের মানুষ বলে আকৃষ্ট করতে চাইলে তাকে বেশি মাছ দিয়ে দ্রুত বিদায় করে। আবার মালাবদল করে বিয়ের পর স্ত্রীকে নিয়ে থাকার সময় তিলকের নিষেধ মেনে সে স্ত্রীর কাছে যায় না লজ্জায়। তিলকের ধমকে সে লজ্জা পেয়ে সুবলকে নিয়ে এক বিছানায় শোয়। ছোটবেলা থেকে যাকে বোনের মতো দেখে আসে তাকে বিয়ে করতে তার রুচিতে বাধে। বাসন্তীকে বিয়ের কথা বললে সে কথাই সে সুবলকে জানায়-
"নারে সুরলা, আমার মন যেমন কয়, কথাখানা ঠিক না। যারে লেংটা থাইক্যা দেখতাছি- ছোটকালে যারে কোলে পিঠে লইছি-হাসাইছি, কাঁদাইছি, ডর দেখাইছি, ভেউরা বানাইয়া দিছি-তারে কি বিয়া করন যায়! বিয়া করন যায় তারে, যার লগে কোনোকালে দেখাসাক্ষাৎ নাই। দেখাসাক্ষাৎ খালি মুগাচণ্ডীর সময়-গীত- জোকারের লগে পিড়ির উপর শাড়ীর ঘোমটা তুইল্যা যখন চোখ মেইল্যা চায় সে হয় সত্যের স্তিরি। আর হগল তো ভইন।" এখানে কিশোরের যেমন রুচিবোধের প্রকাশ তেমন রোমান্টিকতারও প্রকাশ পেয়েছে।
বয়সে তরুণ হলেও সামাজিকতার জ্ঞান কিশোরের টনটনে। তিলক যখন হোলির রাজা হতে চাচ্ছিল তখন কিশোর তাকে নিরস্ত করে এই বলে যে, "আম্রা বিদেশি মানুষ। সভ্য হইয়া বইয়া থাকাই ভালো। নাচানাচি করিলে তারা পাগল মনে করব।" কিশোর ছিল প্রেমিক, মনের। সে স্ত্রীকে এতটাই ভালোবেসেছিল যে, স্ত্রী অপহরণের পরে নদীর জলে অনামা নারীর মৃতদেহ দেখে মনোযন্ত্রণা সহ্য করতে পারেনি, উন্মাদ হয়ে যায়। কিশোরের এ ট্র্যাজেডি অনন্তর মার জীবনেও ট্র্যাজেডি বয়ে আনে। অনন্তর মাকে অর্থাৎ তার স্ত্রীকে পেয়ে যেদিন সে সুস্থ অবস্থায় ফিরে আসতে শুরু করে সেদিনই সে অন্যদের প্রহারে আহত হয় এবং পরের দিন মারা যায়।
কিশোর চরিত্রটি এ উপন্যাসের অন্যতম প্রধান একটি চরিত্র। কিশোরের পরিণতি আমাদের ব্যথাতুর করে। কিশোরের পরিণতি অনন্ত ও অনন্তর মার পরিণতিতেও প্রভাব রেখেছে। কিশোরের মা-বাবার স্বপ্নও চূর্ণবিচূর্ণ হয়েছে। ঔপন্যাসিক যেহেতু কাহিনির প্রয়োজনে তিতাস পাড়ের মানুষের জন্মমৃত্যু বর্ণনা ও ব্যাখ্যা করার জন্য চরিত্রগুলো নির্মাণ করেছেন, সেহেতু অনেক চরিত্রের মধ্যে বিপুল সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও পরিপূর্ণ হয়ে উঠতে পারেনি। কিশোর সেরকম যুবকটি অনন্ত সম্ভাবনাপূর্ণ চরিত্রের মধ্যে অন্যতম একটি।