লোকসাহিত্যের সংজ্ঞার্থ নির্দেশপূর্বক বাংলা লোকসাহিত্যের শ্রেণিবিন্যাসের পরিচয় দাও। অথবা, লোকসাহিত্যের সংজ্ঞাসহ বিভিন্ন শাখার পরিচয় দাও।

লোকসাহিত্যের সংজ্ঞার্থ নির্দেশপূর্বক বাংলা লোকসাহিত্যের শ্রেণিবিন্যাসের পরিচয় দাও। অথবা, লোকসাহিত্যের সংজ্ঞাসহ বিভিন্ন শাখার পরিচয় দাও।
বাংলা লোকসাহিত্য নদীর মতো প্রবাহিত; যা আপন স্রোতধারায় বিচিত্র। এতে জীবনের বিচিত্র রং ও বর্ণ ব্যবহার করে জীবনকে ফুটিয়ে তোলা হয় অতি সহজ ভাষায়। বিষয় বৈচিত্র্যের দিক থেকে লোকসাহিত্যকে প্রধানত ছয়টি ভাগে ভাগ করা যায়। যথা: ১. ছড়া, ২. গান, ৩. গীতিকা, ৪. কথা, ৫. ধাঁধা ও ৬. প্রবাদপ্রবচন। এছাড়া মঙ্গলকাব্য, পাঁচালি, বাউল, শ্যামাসংগীত লোকসাহিত্যের এক একটি প্রধান শাখা। যাত্রা, কবিগান, আখড়াই ও টপ্পা প্রভৃতি রচিত হয়েছে মধ্যযুগ ও আধুনিক যুগের সন্ধিক্ষণে। এগুলো ছিল বাংলার লোকশিল্পের বাহন। 
লোকসাহিত্যের প্রাচীনতম নিদর্শন হলো ছড়া। প্রধানত শিশুদের আনন্দ দানের জন্য ছড়া রচিত হয়েছিল। সাবলীল ভাষায় শিশুর মনে আনন্দের খোরাক জোগায় এ ছড়াগুলো। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার 'ছেলেভুলানো ছড়া' গ্রন্থে অনেকগুলো ছড়াকে সংগ্রহ করে সংরক্ষিত করেছেন। ছড়াগুলো শিশুহৃদয়ে কল্পনার রাজ্য তৈরি করে। যেমন- 
"আম পাতা জোড়া জোড়া /মারব চাবুক চড়ব ঘোড়া
ওরে বুবু সরে দাঁড়া/আসছে আমার পাগলা ঘোড়া।"
লোকসাহিত্যের অন্যতম উপকরণ লোকগীতি। লোকগীতিতে গ্রামের সহজসরল রূপটি ধরা পড়ে। লোকগীতি লোকের মুখে মুখে ফিরে নিত্যনতুন রূপ লাভ করে। লোকগীতিতে জীবনের জটিলতা নেই। স্বচ্ছ পানির মতোই স্বচ্ছ এর গাঁথুনি। 
বাংলাদেশের লোকসংগীত মূলত কাব্যধর্মী। এ সংগীতে বাদ্যযন্ত্রের চেয়ে মৌখিক সুরের দক্ষতার ওপর অধিক নির্ভরশীলতা লক্ষ করা যায়। লোকগীতিকে আমরা সাতটি শ্রেণিতে বিন্যস্ত করতে পারি। এগুলো হচ্ছে প্রেম, ধর্মীয় বিষয়, দর্শন ও ভক্তি, কর্ম ও পরিশ্রম, পেশা ও জীবিকা, ব্যঙ্গ ও কৌতুক এবং এসবের মিশ্রণ। অন্যদিকে, এদেশীয় লোকসাহিত্যে আমরা গানের বিভিন্ন শাখা দেখতে পাই। এগুলো হচ্ছে বাউল গান, ভাওয়াইয়া, ভাটিয়ালি, গম্ভীরা, কবিগান, জারিগান, সারি গান, ঘাটু গান, যাত্রা গান, ঝুমুর গান, জাগের গান প্রভৃতি।
গীতিকা লোকসাহিত্যের একটি বড় অংশ জুড়ে রয়েছে। গীতিকা সাহিত্যে সাধারণত কোনো দৈব দুর্ঘটনা বা কোনো বিয়োগান্ত প্রেমকাহিনির বর্ণনা থাকে। গীতিকা সাহিত্যের মধ্যে অন্যতম হলো নাথ গীতিকা, মৈমনসিংহ গীতিকা এবং পূর্ববঙ্গ গীতিকা। বাংলা লোকসাহিত্যের আকাশে মৈমনসিংহ গীতিকা উজ্জ্বল নক্ষত্র। মহুয়া, মলুয়া, সোনাই, কাজল রেখা, লীলাবতী এক একটি উজ্জ্বল অংশ। মহুয়া পালার দুটি পঙ্ক্তি- 
 "জল ভর সুন্দরী কইন্যা জলে দিছ ঢেউ।
হাসি মুখে কওনা কথা সঙ্গে নাই মোর কেউ।"
বাংলায় শিশুসাহিত্যের শাখায় পড়ে রূপকথা ও উপকথা। মেয়েলি ব্রতের সঙ্গে সম্পর্কিত কাহিনি অবলম্বনে তৈরি হয় ব্রতকথা। দক্ষিণারঞ্জন মিত্রমজুমদার প্রচলিত রূপকথাগুলোকে লিখিত রূপ দিয়েছেন। তার 'ঠাকুরদার ঝুলি' ও 'ঠাকুরমার ঝুলি' রূপকথার গ্রন্থ হিসেবে সুপরিচিত। মেয়েলি ব্রতকথাগুলো লৌকিক দেব দেবীর মাহাত্ম্যগানের উদ্দেশ্যে রচিত। ব্রতকথাগুলো বাংলা আদিমকাব্য। বিভিন্ন ধরনের ব্রত রয়েছে। যেমন- সেঁজুতি ব্রত, তুষ তুষালি ব্রত, পুণ্যপুকুর ব্রত, সাবিত্রী ব্রত, লক্ষ্মীর ব্রত ইত্যাদি। এগুলোর মাধ্যমে মেয়েরা গৃহের শান্তি ও কল্যাণ বয়ে নিয়ে আসবে, এ বিশ্বাস ছিল সবার মনে। 
ধাঁধা লোকসাহিত্যের অন্যতম প্রাচীন শাখা। এর মধ্যে সূক্ষ্মা বুদ্ধির পরিচয় পাওয়া যায়। মাহবুবুল আলমের ভাষায়, এতে বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশের যে নিদর্শন পাওয়া যায় তাতে তাকে কেবল আদিম মানুষের সৃষ্টি মনে না করে বুদ্ধিবৃত্তিসম্পন্ন মানবমনের সৃষ্টি বলে বিবেচনা করাই যৌক্তিক মনে হয়। যেমন- ক. আকাশ গুড় গুড় পাথর ঘাটা, সাতশ ডালে দুইটা পাতা। খ. বাগান থেকে বেরুল টিয়ে, সোনার টোপর মাথায় দিয়ে। গ. আকাশ থেকে পড়ল এক বুড়ি, তার মাথায় চুলের ঝুড়ি। এ তিনটি ধাঁধার উত্তর যথাক্রমে 'চাঁদ ও সূর্য', আনারস এবং ঢোল। 
গ্রামবাংলার সহজসরল মানুষের অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞানচর্চা হচ্ছে প্রবাদ-প্রবচন। প্রবাদ-প্রবচনের শব্দ-বিন্যাস খুব সংযত হয় তাই একে কাব্যিক মর্যাদা দেওয়া যায়। বাংলার কৃষক সমাজে প্রবাদ হলো জ্ঞান ও সত্য প্রচারের মাধ্যম। প্রবাদ বাক্যের মাধ্যমে তারা নৈতিক ধারণা পেত। এখনো পর্যন্ত এগুলো পল্লিসমাজে সযত্নে লালিত হচ্ছে। উদাহরণ- 
 "সহস্র বরন গাভীরে ভাই একই বরন দুধ।
জগৎ ভরমিয়া দেখলাম একই মায়ের পুত।" 
খনার বচন, ডাকের কথা প্রভৃতিও প্রবাদ বাক্যের অন্তর্গত। ডাক ও খনার বচন বাঙালির প্রাত্যহিক জীবনের সাথে মিশে আছে। উদাহরণ- 
 "চার চাষে ধান/তার অর্ধেক পান
ষোল চাষে মুলা/তার অর্ধেক তুলা।"
লোকগল্প মানুষের মুখে মুখে প্রজন্মের পর প্রজন্ম পাড়ি দিচ্ছে। এগুলো গদ্য আকারে রচিত। বিষয়, অর্থ এবং গঠনের ওপর ভিত্তি করে লোকগল্প হতে পারে রূপকথা, মিথ, অ্যাডভেঞ্চার গল্প, বীরত্বের গল্প, ঐতিহাসিক গল্প, মনীষীদের গল্প ইত্যাদি। এদেশীয় গল্পের চরিত্রগুলো মূলত ভাগ্যনির্ভর এবং গল্পগুলোতে জ্ঞান, বুদ্ধির বদলে জাদুকরী শক্তির প্রাধান্য দেখা যায়। 
 
উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, বাংলাদেশের লোকসাহিত্য বাংলা সাহিত্য, কৃষ্টি, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যে বিশেষ ভূমিকা রেখেছে। যদিও এর সৃষ্টি ঘটেছে অশিক্ষিত জনগোষ্ঠীর মাধ্যমে এবং প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে প্রসার ঘটেছে মৌখিকভাবে, তথাপি বাংলা সাহিত্যকে এ লোকসাহিত্য ব্যাপ্তি প্রদান করেছে, করেছে সমৃদ্ধ। পৃথক পৃথক ব্যক্তিবিশেষের সৃষ্টি পরিণত হয়েছে জনগোষ্ঠীর ঐতিহ্যে; যার মাধ্যমে প্রকাশ ঘটেছে ভালোবাসা, আবেগ, অনুভূতি ও চিন্তাচেতনার।
আপনারঅদৃশ্যমন্তব্য
Cancel