সুবোধ ঘোষের গল্পের শিল্পমূল্য বিচার কর।অথবা, "মানব-মনস্তত্ত্ব বিশ্লেষণে সুবোধ ঘোষের ছোটগল্প বৈচিত্র্যময়।” – প্রাসঙ্গিক গল্পের আলোকে উক্তিটি যাচাই কর।
বাংলা সাহিত্যে সুবোধ ঘোষের (১৯০৯-১৯৮০) আবির্ভাব
যেমন আকস্মিক তেমনি চমকপ্রদ। ছোটগল্পের জগতে সুবোধ ঘোষ একজন কুশলী এবং বুদ্ধিদীপ্ত লেখক। তিনি জীবনকে দেখেছেন নানা দৃষ্টিকোণ থেকে। যুগলক্ষণের দুটি দিক প্রথমটি অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক, দ্বিতীয়টি শিল্পগত দিক। প্রথমটির আবহাওয়াতে লেখকরা তৈরি হন, দ্বিতীয়টি তারা তৈরি করেন। একজন লেখক যখন শিল্পবোধকে প্রভাবিত করে থাকেন, তখন তিনি পাঠক সমাজের কাছে অপরিচিত হলেও পরিচিত হয়ে ওঠেন সাহিত্যের ইতিহাসের মাধ্যমে। দুই বিশ্বযুদ্ধের সন্ধিলগ্নে কয়েকজন কথাসাহিত্যিকের আবির্ভাব হয়েছিল, তাদের মধ্যে বিশেষভাবে আলোচনার পর্যায়ে এসেছিলেন সুবোধ ঘোষ। তৎকালীন রাজনীতি বলতে বিশ্বযুদ্ধের প্রভাবে প্রভাবিত হয়ে রাজনীতি, দুই বিশ্বযুদ্ধের সমকাল থেকে বেকারত্ব, খাদ্যাভাব, আবাসন সমস্যা, অস্তিত্বের সংকটে আপামর মানবজীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছিল।
সুবোধ ঘোষের প্রথম গল্প অযান্ত্রিকে দেখা গেছে মধ্যবিত্ত মানসিকতার উত্তরণ। একালের সামাজিক ও পারিবারিক সম্পর্কহীন নিঃসঙ্গ মানুষের সঙ্গে যন্ত্রের সম্পর্ক হৃদয়ানুভূতির নয়; বরং এ সম্পর্ক ততদিনই স্থায়ী হয় যতদিন যন্ত্র মানুষের অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থানের সংস্থান করে দিতে সক্ষম হয়। আধুনিক জীবনের এই নিগূঢ় রহস্য ও নির্ভেজাল বাস্তবকে অযান্ত্রিক গল্পের বিষয় হিসেবে গ্রহণ করেছেন গল্পকার সুবোধ ঘোষ। সাবেক আমলের একটি ফোর্ড গাড়ি যা দেখতে যদিও জবুথবু কিন্তু কাজের বেলা বড়ই অদ্ভুতকর্মা। তবুও গাড়ির চালক বিমল আদর করে এর নাম রেখেছে 'জগদ্দল'।
বাংলা সাহিত্যে অবলা জীবকে নিয়ে বেশ কয়েকটি উৎকৃষ্ট গল্প লেখা হয়েছে। শরৎচন্দ্রের 'মহেশ', প্রভাতকুমারের 'আদরিণী', তারাশঙ্করের 'কালাপাহাড়' প্রভৃতি। কিন্তু যন্ত্রকে নিয়ে অযান্ত্রিকের মতো এমন অসাধারণ গল্প বাংলা সাহিত্যে 'একমেবাদ্বিতীয়ম্'।
এ গল্পে জগদ্দলের শ্রী ও শক্তি কোনোটাই আর প্রায় নেই। তবু যাত্রী বোঝাই করে কোনো জরাতুর প্রাগৈতিহাসিক জীবের মতোই ছোটে। তখন সে পথের ধুলো ওড়ায়, কানফাটা আওয়াজ তুলে মোষ খ্যাপায়। ট্যাক্সি স্ট্যান্ডের সকলে এই গাড়িটিকে নিয়ে হাসিঠাট্টা করে। শুনলে ক্ষিপ্ত বিমল তার জবাব দেয় একেবারে মোক্ষম। বিমলের প্রশ্রয়ে জগদ্দলের কোনো স্বাদ, আহ্লাদই অপূর্ণ থাকে না।
কতরকমই না বিদ্রূপ আর বিশেষণ পেয়েছে এ গাড়িটা। বুড্ডা ঘোড়া, খোঁড়া হাঁস, কানা ভইস। কিন্তু তা বিমলের আদরের জগদ্দল। তার ব্যস্তত্রস্ত কর্মজীবনে সুদীর্ঘ পনেরোটি বছরের সাথি এ যন্ত্রপশুটা। সেবক, বন্ধু আর অন্নদাতা। মনে হতে পারে যন্ত্র কি মানুষের আবেগে সাড়া দেয়? অন্যের পক্ষে বুঝা কঠিন হলেও বিমল জগদ্দলের প্রতিটি স্বাদ, আহ্লাদ, অভিমান পলকেই বুঝে নিতে পারে- "ভারী তেষ্টা পেয়েছে, না রে জগদ্দল? তাই হাঁসফাঁস করছিস্? দাঁড়া বাবা দাঁড়া।" বিমল জল এনে রেডিয়েটরের মুখে ঢেলে দেয়, জগদ্দল আবার চলতে থাকে। বিমলের অগাধ বিশ্বাস - জগদ্দলের ওপর। সারাদিন এই কুদৃশ্য বুড়ো গাড়িটা খদ্দের না পেলেও দুর্যোগে-দুর্দিনে এখনও তো সে দুর্দমনীয় গতিতে ছুটে চলে। বিমলের একমাত্র আশাভরসার অকৃত্রিম বন্ধু আজও তো এই জগদ্দল। রুজি রোজগারে টান পড়েছে, তবুও এ গাড়িটার ওপর মায়া ছাড়তে পারে না। নিজের ঘড়ি, বাসনপত্র, তক্তপোশ পর্যন্ত বেঁচে দিয়ে কলকাতা থেকে গাড়ির কলকব্জা আনিয়েছে বিমল, রাত জেগে সারিয়ে তোলার চেষ্টা করেছে জগদ্দলকে। কিন্তু কালের নিয়তি রোধে সাধ্য কার। তাই পরদিনই ভেঙে গেল বিমলের সব স্বপ্ন- "ফার্স্ট, সেকেন্ড, থার্ড- প্রত্যেকটি গিয়ার পর পর পাল্টে টান দিল বিমল। শেষে রাগ চড়ে গেল মাথায়- "চল, নইলে মারব লাখি।" বুনো রাগে ক্ষেপে উঠল বিমল- "আদর বোঝে না, কথা বোঝে না, শালা লোহার বাচ্চা...।"
বিমলের জীবনে ফুরিয়ে গেল জগদ্দলের প্রয়োজন। যুদ্ধের বাজারে লোহার চাহিদা খুব। তাই কলকাতা থেকে পুরানো লোহার দরে জগদ্দলকে কিনে নিতে লোকও এসে হাজির হলো। বিষয়বস্তুর পাশাপাশি গল্পের আঙ্গিকেও অভিনবত্বের প্রকাশ ঘটেছে। জগদ্দল এ গল্পে একটি সার্থক চরিত্রের মাত্রা পেয়েছে। তাই যন্ত্র হয়েও সে অযান্ত্রিক। জগদ্দলের সঙ্গে বিমলের আচার আচরণ এবং সংলাপ একই সঙ্গে বিমলকে যেমন আমাদের কাছে তুলে ধরে, তেমনি জগদ্দলকে দেয় একটি সুসম চরিত্রের মাত্রা। সংলাপের পাশাপাশি বিমলের অন্তর্সংলাপও আছে এ গল্পে জগদ্দলকে ঘিরে। কিন্তু বিষয়বস্তুর ভার নেই। এককথায়, একটি যন্ত্রকে ঘিরে মানুষের হৃদয় রহস্যের গল্প। লেখক গল্পের সূচনাতেই যন্ত্র ও মানুষের সমন্বয়টি তৈরি করেছেন- "বিমলের একগুঁয়েমি যেমন অব্যয়, তেমনি অক্ষয় তার ঐ ট্যাক্সিটার পরমায়ু।” কিন্তু গল্পটি শেষ পর্যন্ত এসে পৌঁছেছে এক বিপরীত মাত্রায়। যেখানে সুনিশ্চিত নিয়তিতে মধ্যবিত্ত বিমলের একগুঁয়েমিও আর রক্ষা করতে পারেনি জগদ্দলের পরমায়ুকে।
মধ্যবিত্তের দ্বিধাদীর্ণ মানসিকতার আর এক প্রকট রূপ লক্ষ করা যায় ফসিল গল্পে। জীবজন্তু ফসিল হতে পারে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের মধ্যে পড়ে। কিন্তু মানুষেরই সৃষ্ট মৃত্যুতে আরেক শ্রেণির মানুষ ফসিল হবে আজ থেকে কয়েক লক্ষ বছর পরেই এতা কল্পনাতীত। কিন্তু সাড়ে আটষট্টি বর্গমাইল আয়তনের দেশীয় রাজ্য অঞ্জনগড়- যেখানে লাঠির দাপটে চলে রাজ্যশাসন। সেখানে মধ্যবিত্তের স্বার্থপূরণের কারণে রাত্রি ঘন অন্ধকারে খনিগর্ভে ধসে পড়ে পীঠের তলায় বিপ্লবী মানুষের গণআন্দোলন চাপা পড়ে ফসিলে পরিণত হয়েছে। যা মানবসভ্যতার ইতিহাসে কলঙ্ক। গল্পের সিদ্ধান্ত বাক্যে মিস্টার মুখার্জির গভীর অথচ হতাশাচ্ছন্ন অসহায় মননের বহিঃপ্রকাশ। যা গোটা মানবজাতির বিড়ম্বিত ভাগ্যের নির্দেশক ও সভ্যতার অধোগমনের পরিচায়ক- "লক্ষ বছর পরে, এই পৃথিবীর কোন একটা জাদুঘরে, জ্ঞানবৃদ্ধ প্রত্নতাত্ত্বিকের দল উগ্র কৌতূহলে স্থির দৃষ্টি মেলে দেখছে কতকগুলো ফসিল।"
সুবোধ ঘোষের গল্পে দেখা যায়, মধ্যবিত্ত শ্রেণির যন্ত্রণা। জীবিকান্বেষী মধ্যবিত্তের বাধ্যতামূলক ক্রমাবনতির গল্প গোত্রান্তর। মধ্যবিত্তের ভন্ডামি, আত্মপ্রতারণা, ভীরুতা, নীচতা ও অন্যায়ের সঙ্গে আপসহীন সুবিধাবাদী প্রবণতাকে ফুটিয়ে তুলেছেন গোত্রান্তর গল্পে। অর্থ, ক্ষমতা, সামাজিক মর্যাদা, জীবনের পথে উচ্চাশা মধ্যবিত্ত শ্রেণির চিরকালীন স্বপ্ন। আর এ স্বপ্নই জেগে উঠেছিল
মধ্যবিত্ত শ্রেণির এক প্রতিনিধি গোত্রান্তর গল্পের নায়ক স্বার্থান্ধ
সঞ্জয়ের হৃদয়াবেগে। মধ্যবিত্ত শ্রেণির দোলাচলচিত্ততা, তাদের শ্রেণি | মানসিকতার বিশ্লেষণ এবং সুবিধাবাদের ওপর নির্মম কশাঘাতপূর্ণ
এক অসামান্য গল্প গোত্রান্তর। মধ্যবিত্তের গোত্রান্তর সহজে ঘটে
না। মধ্যবিত্ত যৌথ পরিবারে অর্থনীতিতে এমএ পাস ছেলে সঞ্জয় বিংশ শতাব্দীর বিপ্লবী ধনবিজ্ঞানের সমস্ত সূত্রগুলো মুখস্ত করে ফেলেছে। সে বুঝেছে এ সংসারে প্রত্যেকটি স্নেহ পণ্যমাত্র, ■ প্রত্যেকটি আশীর্বাদ এক একটি পাওনার নোটিশ। সঞ্জয় পরিবারের সংস্রব ত্যাগ করে পুরানো সত্তাকে লোপ করতে এসেছে রতনলাল সুগার মিলের চাকরিতে। চিনিকলের মালিক রতনলাল ■ যখন আখ চাষি আর নীল মজুরদের ঠকাতে শুরু করে তখন সঞ্জয়ের নেতৃত্বে শ্রমিক ও চাষিরা প্রতিরোধ গড়ে তোলে। কিন্তু লেখক জানেন, মধ্যবিত্তেরা কখনো গোত্রান্তর ঘটিয়ে লড়াইয়ে নেতৃত্ব দিতে পারে না, গোত্রহীন মানুষেরা যেমন পারে। তাই গোত্রহীন মানুষের বিদ্রোহী রূপ দেখে আঁতকে উঠল গোত্রভ্রষ্ট মধ্যবিত্তের সন্তান সঞ্জয়। মালিকে-শ্রমিকে একটা সামান্য দলাদলির এমন রুদ্র পরিণাম হবে সেকথা কল্পনাও করতে পারেনি। আসলে মধ্যবিত্ত নিজের কথা ভাবে, নিজের ভালো চায়, তাতে অন্যের ক্ষতি হলেও তার কিছু যায় আসে না। তাই গল্পে দেখা যায়, মধ্যবিত্ত সঞ্জয় নিজের ভালোর কথা ভেবে চাষি- মজুরদের লড়াই থেকে সরে দাঁড়ায়। ভালো হতে চায় মধ্যবিত্ত অন্যের কাছে। তাই বিশ্বাসঘাতকতা করে রাতের আঁধারে ছুটে যায় সঞ্জয় মালিক রতনলালের কাছে। রতনলাল সঞ্জয়কে হাতে পেয়ে পুরস্কৃত করে পঞ্চাশ টাকা বকশিশ ও কয়েকদিনের ছুটি। তারপর গোরখপুরে মিলে চাকরি 'শুও রূপেয়া তন্থা'। পলায়নপর মধ্যবিত্ত সঞ্জয় বিশ্বাসঘাতকতা করে পালিয়ে যায় রামখেরি রেঞ্জের গায়ে সমজঙ্গীর পথে ঘোড়া ছুটিয়ে। আকাশের বুকটা তখন লাল হয়ে গেছে। কিষানেরা আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছে নিজের খেতে। তাতে সঞ্জয়ের তো কোনো ক্ষতি নেই। সামনের মাঠটা পার হলেই স্টেশন। "সঞ্জয় ঘোড়া থেকে নেমে স্রোতের ধারে বসে আঁজলা ভরে জল খেল। গেরস্থের মুরগি চুরি করে একটা শেয়াল ভেজা বালির উপর বসে গোঁপের রক্ত চাটছিল। সেও জল খাবার জন্য স্রোতের মুখে নামলো।" গল্পকার এখানে দেখিয়েছেন ভীরু মধ্যবিত্ত সঞ্জয়ের সঙ্গে ঐ মুরগিচোর শেয়ালের কোনো তফাত নেই। কারণ ইচ্ছে করলেই মধ্যবিত্ত তার গোত্র বদল করতে পারে না।
পরশুরামের কুঠার স্তন্যপীযূষদায়িনী জননীকে সমাজের অনুশাসন কুঠারে হত্যা করে তাকে মার্কামারা বারবনিতার দলে ঠেলে দেওয়ার
মর্মান্তিক কাহিনি। লেখক এ গল্পে দেখিয়েছেন পুরুষশাসিত
সমাজের বর্বরতায় ও ধনতন্ত্রের উপযোগবাদী কঠোর মানসিকতায়
মাতৃত্বের চরম অপমৃত্যু। পুরুষশাসিত সমাজে আমরা সকলেই
মাতৃহন্তাকারী এক পরশুরাম। হয়তোবা সমাজটাই মাতৃহন্তাকারী
অভিনব এক পরশুরামের রুক্ষ কঠোর খাদ্যমূর্তিতে উদ্ভাসিত। গল্পকার এখানে পৌরাণিক নামের আশ্রয়ে তৎকালীন
বাঙালি সমাজকে ব্যঙ্গের কশাঘাতে জর্জরিত করেছেন। গল্পের
মুখ্য চরিত্র দেহাতি যুবতি ধনিয়া। সে সুস্থ স্বাভাবিক জীবনযাপন করে না। যার মুখ্য পরিচয় তিলকের মা হিসেবে। তবে
তিলকের বাবা কে তা কেউ জানে না। অদ্ভুত এক পন্থাতে ধনিয়া প্রতি বছর মিশনারি জেনানা হাসপাতালের ফ্রি বেডে একের পর এক সন্তানের জন্ম দিয়ে তাদের মিশনারির অনাথালয়ে চালান করে আসে নিজের 'ছাগল লজে'। আসলে বুকের দুধ খাইয়ে অপরের বাচ্চাকে মানুষ করাই ছিল তার পেশা। তাই মাতৃত্ব তার পেশা, দেহ তার পণ্য। কিন্তু সমস্যা দেখা দিল যুদ্ধ পরবর্তীকালের বছরগুলোতে। সাগরপাড় থেকে ধনিয়ার বহু নতুন প্রতিদ্বন্দ্বী এসেছে। হরেক রকম বিলেতি ফুড। তাই আজ ধনিয়ার ডাক পড়ে না গৃহস্থের বাড়িতে। আজ সে সমাজের কাছে ব্রাত্য। মধ্যবিত্ত মানসিকতাই এমন। যখন দরকার ছিল বাড়িতে গেলে কোনো দোষ ছিল না। কিন্তু আজ দরকার নেই।। তাই পর্বের দিনে এলেও আপত্তি। সে আজ সমাজের চোখে 'রান্ডী'। পরশুরামের কুঠার নামটা শুনলেই আমাদের পুরাণের কথা মনে পড়ে যায়। কিন্তু সাবেক পুরাণ কথার একটি বর্ণও কার্যত এ গল্পে বর্ণিত হয়নি। তবু গল্পের ঘটনাপ্রবাহের মধ্যে যে চরম কৃতঘ্নতার পরিচয় আছে 'মা' ধনিয়ার প্রতি, তাই যেন স্মৃতির সরণিতে পরশুরামের পৌরাণিক মাতৃঘাতকের প্রসঙ্গকে নতুন তাৎপর্যে ফিরিয়ে এনেছে। বিশেষত ধনিয়া যখন দেখে "সক্কা' চেহারা ঘোষালবাবুর বড় ছেলেটা ঘনঘন সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়চে”- তার দিকে তাকানো সেসব উঠতি তরুণের আবেদনময় কামনামদির চোখের ধার তাকে পরশুরামের কুঠারের মতোই ছেদন করে, রক্তাক্ত করে, নিহত করে। কারণ তথাকথিত সন্তানেরা ভুলে গেলেও তাদের দুধমা ধনিয়া তো ভোলেনি সেসব দিনের কথা, সেসব ঋণের কথা। একদিন বুকের দুধ খাইয়ে যে সমস্ত সন্তানদের নবজীবন দান করেছিল ধনিয়া তাদেরই কামনার কুঠারে যখন ক্ষতবিক্ষত হয় তখন নিজেই উদ্যোগী হয়ে নিজেকে শান্তি দিতে চেয়েছে। কোন এক আক্রোশে "একঢোক পানের পিক গিলে নিল ধনিয়া। কান দুটো তেতে ঘেমে উঠেছে। আঁচলটা গা থেকে পেছনে ঠেলে নামিয়ে দিল। দুহাত তুলে মাথার উপর জানালার খিলানটা ধরে বুকটা সামনের গরাদের ফাঁকে জোরে চেপে ধরল ধনিয়া। জনতার চোখে ধাঁধা। অসংবৃতা এক রঙিন মরীচিকার মূর্তি জ্বলছে জানালার উপর। নীচে পাতলা রেশমী শাড়ির আড়ালে আঁকা দুটি সুস্পষ্ট জঙ্ঘার ছায়াময় লোভানি। উপরে একজোড়া দুরন্ত সবুজ গ্রহ; কাঁচুলির বন্ধনে চিরকালের মতো গতিহারা।"
সুন্দরম নামের আড়ালে সুবোধ ঘোষ জীবনকে দেখার এক
বিশেষ জীবনদৃষ্টির প্রকাশ ঘটিয়েছেন। একদিকে সুকুমারের রূপতত্ত্ব,
অন্যদিকে কৈলাসডাক্তারের সুন্দরের সংজ্ঞায় উদার আদর্শলালিত
সৌন্দর্যভাবনা। এই দুইয়ে মিলিয়ে পরিস্ফুট হয়েছে গল্পের
কেন্দ্রীয় সত্য। তাই গল্পটি পড়ে কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী মন্তব্য
করেছিলেন, "সৌন্দর্য নামক ব্যাপারটা সম্পর্কে যেসব সংস্কার আমাদের চিত্তে নিয়ত ক্রিয়াশীল, এ গল্পের উপসংহারে সেগুলোকে আছড়ে মেরে ভেঙে ফেলা হয়েছে।... কিন্তু এই যে বিনিশ্চয় যা কিনা সৌন্দর্যতত্ত্বের একটি মৌলিক সত্যের দিকে আমাদের চোখ ফিরিয়ে দেয়, এটি আমাদের প্রত্যাশার বৃত্তে ছিল না...।"
বারবধূ গল্পে লতা সচেতনভাবেই জানে সে রক্ষিতা। সে অর্থের বিনিময়েই তারকেশ্বর থেকে প্রসাদ রায়ের গৃহে এসেছে। কিন্তু আকস্মিক একটি সন্ধ্যার কপট গৃহবধূর অভিনয় সত্য আকাঙ্ক্ষায় রূপান্তরিত হয়ে এই যৌনকর্মীর মানস পরিবর্তন ঘটালো। তার জীবনের এক নতুন চেতনার দ্বার খুলে দিল মিথ্যা পরিচয়ে লতা সামাজিক মানুষের কাছে যে সম্মান, যে আদর পেল, তার অনুভূতি তার সমস্ত মনকে অধিকার করে বসল। সে প্রসাদের জীবনে স্থায়ীভাবে প্রবেশের উপায় খুঁজে ফিরল মনোমধ্যে। কিন্তু সেখানে প্রবেশের কোনো পথ নেই। কারণ কুলকন্যা বিধবা আভা সে পথ আগলে রয়েছে। লতা ও প্রসাদকে সত্য সত্যই স্বামী-স্ত্রী বলে জানে আভা। তারপরও প্রসাদকে কামনা করে। প্রসাদও তার মায়াজালে ধরা পড়ে। বিদায় মুহূর্তে প্রসাদ যখন লতার হাতে টাকার নোটগুলো তুলে দিয়ে বলেছে, "আমি তো তোমাকে কখনো ঠকাইনি, ক্ষতি করিনি।" তখন লতা অভিমানে, চোখের জল লুকোবার চেষ্টা করে বলে- "না তুমি ক্ষতি করনি, আভা ঠাকুরঝি আমার এই সর্বনাশটা করে ছাড়লো।"
মানুষের নীড় ভাঙার কাজে নিয়োজিত কুলনারী আভার বিরুদ্ধে এ অভিযোগ তার হৃদয়ের কথা। একথার দ্বারা বারবধূ ভদ্র সমাজকে ক্ষমাহীন ধিক্কার-ব্যঙ্গ করেছে। এ গল্পে একজন যৌনকর্মীর বারবধূর গৃহী হওয়ার আকাঙ্ক্ষা এবং তা পূরণ না হওয়ায় তার যে অন্তর্বেদনা তাই তুলে ধরা হয়েছে।
মূলত সুবোধ ঘোষের গল্পে বিভিন্ন বিষয়ের উপস্থিতি লক্ষ করা যায় এবং তার গল্পের শিল্পায়ন কৌশলও চমৎকার। প্রমথ চৌধুরীর মতে সুবোধ ঘোষকেও নতুন স্টাইল বা গদ্যরীতির প্রবর্তক বলা যেতে পারে। শ্লেষ ও বক্রোক্তির তীক্ষ্ণতায়, বুদ্ধিদীপ্ত সমাসোক্তির- ব্যঞ্জনায়, কাব্যমণ্ডিত বর্ণনা ও গভীর ভাবদ্যোতক মন্তব্য সংযোজনায় তার বাগবৈদগ্ধ্য সাহিত্যের শিল্পরূপকে এক অভিনব সৌন্দর্যে বিভূষিত করেছে। জীবনবোধের পরিচ্ছন্নতার সঙ্গে এই অসামান্য শিল্পায়ন সুষমাই, বাংলা কথাসাহিত্যে সুবোধ ঘোষের নিজস্ব আসন সৃষ্টি করে দিয়েছে।