সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর ছোটগল্পে প্রতিফলিত ব্যক্তি-অস্তিত্বের গভীরতর নৈরাশ্যবোধের স্বরূপ নির্দেশ কর। অথবা, “সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর অধিকাংশ গল্পই শেষ পর্যন্ত এক - মানবিক পরিণতি অর্জন করে।” – মন্তব্যটি বিশ্লেষণ কর।
বাংলা ছোটগল্পে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ হলেন এমনই স্থপতি, যার স্থাপত্যকর্ম যেমন দৃষ্টিনন্দন, তেমনই স্থাপন প্রক্রিয়াটিও উপভোগ্য, দাবি করে মনোযোগ। কোনো একটিকে বাদ দিলে ঠিক আস্বাদ মেলে না। তাই ওয়ালীউল্লাহর গল্পের পুনঃকথন সম্ভব হয় না। সংক্ষিপ্তভাবে বলা যায় না, প্রতিটি শব্দ পড়তে হয়। গল্পের ভেতরের মূল অংশকে তেমন করে আলাদা করা যায় না। তবে শেষ পর্যন্ত সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর সব গল্পই এক মানবিক পরিণতি অর্জন করে।
সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ গল্পের বিষয় নির্বাচনে ছিলেন জনজীবন সম্পৃক্ত। তার অধিকাংশ গল্পই মনস্তত্ত্বধর্মী ও মনোময়। মানুষের মানবিকতা, অস্তিত্ব সংকট, নিঃসঙ্গতা, অনুশোচনা আর অস্তিত্বমুক্তির বাসনা প্রভৃতি অনুষঙ্গ তার গল্পের মুখ্য বিষয়। সমাজের বহির্বাস্তবতার চেয়ে মানবজীবনের অন্তর্বাস্তবতার জগতেই তার সদর্প বিচরণ। মানবিকতাই তার সাহিত্যিক প্রতিভা এবং ছোটগল্পের অবয়ব নির্মাণে মুখ্য ভূমিকা পালন করেছে। এ মানবিক দর্শনের আলোকেই তিনি হতাশা ও ব্যর্থতাকে অতিক্রম করে জীবন সম্পর্কে একটা সুস্থ ধারণা প্রকাশ করতে পেরেছেন। নিরস্তিত্বের শূন্যতায় ফিরে যাওয়া জীবন নয়, অন্ধকার ভেঙে অস্তিত্বের স্বাধীন সত্তা ও মানবিকতায় উত্তীর্ণ হওয়াই তার ছোটগল্পের মৌল বৈশিষ্ট্য।
মানুষের মানবিকতা, অস্তিত্ব জিজ্ঞাসা ও বেঁচে থাকার প্রশ্নে 'ক্ষুধা' একটি মৌলিক বিষয়। তাই যুদ্ধোত্তর দুর্ভিক্ষ সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর গল্পে মানব অস্তিত্বের প্রশ্নে মৌলিক প্রশ্ন হিসেবেই এসেছে। 'নয়নচারা' ও 'মৃত্যু-যাত্রা' গল্পদ্বয়ে তার সে প্রচেষ্টা শিল্পরূপ পেয়েছে। 'নয়নচারা' গল্পে দুর্ভিক্ষে গ্রাম উজাড় হলে খাদ্যের সন্ধানে আগত মানুষের মিছিলে শহরে এসেছে আমু ও ভূতনি। অল্পদিনের মধ্যেই আমু বুঝতে পারে শহরের লঙ্গরখানায় সামান্য আহার জুটলেও তাতে সবার প্রাণ বাঁচে না। ভুতোর মতো অনেকেই ক্ষুধায় বেঘোরে প্রাণ হারায়। দুর্ভিক্ষ-দীর্ণ আমুর প্রত্যাশা শহরে এসে বিপন্ন ও বিধ্বস্ত হলেও সে সহজে হার মানতে চায় না। সে অস্তিত্ববান হতে চেষ্টা করে ক্ষুধা নিরন্নতার অবস্থানের মধ্য দিয়ে। সে লঙ্গরখানার খাবারের আশাতেই বসে থাকে না, সে খাদ্যের অন্বেষণে পথে নামে। তার কণ্ঠে শোনা যায়, “মা গোঠ চাট্টি ভাত দাও।” তার সে আহ্বান ঘুমন্ত বাড়িগুলোর গায়ে ধাক্কা লেগে ফিরে এলেও সে থামে না, পথ চলতে থাকে খাদ্য অন্বেষণে। একসময় সে হাজির হয় ময়রার দোকানে। সেখান থেকে নির্মমভাবে বিতাড়িত হয়ে একটি হোটেলের সামনে এসে দাঁড়ায়। কিন্তু শহরের অমানবিক আবহাওয়া তাকে করে তোলে বিদ্রোহী। এ বিদ্রোহ তাকে অস্তিত্ববাদী হিসেবে প্রতিষ্ঠা দিলেও অসহ্য মার খেয়ে সে হয়ে ওঠে মানবিক। তাই সে শক্তিশালীর কাছে ক্ষমা চায়। আমুকে শহরের এক নারী সামান্য অন্ন দিলে সে খুশি হয় কিন্তু সে তার স্বাধীন নির্বাচনের মাধ্যমে শহর অপেক্ষা গ্রামকেই তার জন্য বেশি উপযোগী ভেবেছে। সে উপলব্ধি করেছে, তার অস্তিত্বের শিকড় তার গ্রাম নয়নচারার মানবিক পরিবেশেই গ্রথিত।
নগরকেন্দ্রিক ধনবাদী সভ্যতার বিকাশের সঙ্গে মানুষের জীবনাভূতি ও জীবনবাস্তবতার মৌলিক পরিবর্তন এসেছে। মানুষ তার উত্তরাধিকার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। এই নিঃসঙ্গতা, বিচ্ছিন্নতা কখনো আত্মগতভাবে, কখনো পারিবারিক। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-উত্তর সমাজ সংকট এই ব্যক্তি বিচ্ছিন্নতা ও নৈঃসঙ্গ্যবোধকে আরও তীব্র সূচিমুখ করেছে। মানবতাবাদী হয়ে মানুষ এই নিঃসঙ্গতাকে অতিক্রম করতে চায়। 'দুই তীর' গল্পে মানব অস্তিত্বের বিচ্ছিন্ন চেতনাই শব্দরূপ পেয়েছে আফসারউদ্দিন ও তার স্ত্রী হাসিনার দাম্পত্য জীবনের মাধ্যমে। আফসারউদ্দিন বিচ্ছিন্নতাবোধ অতিক্রম করে অস্তিত্বশীল হওয়ার প্রাণপণ চেষ্টা করে। স্ত্রী হাসিনার সাথে তার যে সম্পর্কের শূন্যতা
তা সে অতিক্রম করতে চায়।
আফসারউদ্দিনের দাম্পত্য সম্পর্কের ক্ষেত্রে বিচ্ছিন্নতাবোধ তার হৃদয় সংকট সৃষ্টি করে এবং তা অতিক্রম করে সে নিঃসঙ্গতার মধ্যেই অস্তিত্ববান সত্তায় রূপান্তরের চেষ্টা করে। একটি বিষয়ে সে নিশ্চিতবোধ করে, তার জীবন সে মরুভূমির উপর সৃষ্টি করবে না। তাই "অকস্মাৎ আফসারউদ্দিন মনস্থির করে, হাসিনা ঘুমিয়ে পড়ার আগেই আজ তাকে কিছু কথা মন খুলে বলবে। কতদিন আর তাদের দাম্পত্য জীবনের এই প্রহসন চলবে।" কারণ আজ সে একটি পরিপূর্ণ নিঃসঙ্গতার মধ্যে আপন অস্তিত্ব ফিরে পেয়েছে, সে অস্তিত্বটি প্রশ্ন বিশ্লেষণে ক্ষতবিক্ষত করতে চায় না সে। এজন্য মানবিকবোধ থেকেই সে প্রত্যাশা করেছিল, হাসিনা মায়ের প্ররোচনায় চলে গেলেও মানবিকবোধের জাগরণে হাসিনা ফিরে আসবে।
'একটি তুলসী গাছের কাহিনী'তেও ব্যক্তির বিচ্ছিন্নতা ও মানবিকবোধ স্পষ্ট। এ বিচ্ছিন্নতার পটভূমি দেশকাল ও সমকালীন রাজনীতি বাহিত হয়েই তা ব্যক্তিকে স্পর্শ করেছে ও তার অন্তরে হয়েছে কেন্দ্রীভূত। নিম্নমধ্যবিত্তের অস্তিত্ব সংকট ও সংকট মুক্তির লক্ষ্যে একটি পরিত্যক্ত বাড়ি দখলের মধ্য দিয়ে এ গল্পের কাহিনির সূত্রপাত। বাড়ি দখল করে নিম্নবিত্ত কেরানিরা তৃপ্ত স্বপ্নাতুর জীবন প্রতিষ্ঠায়। কিন্তু অল্পদিন পরেই আশ্রয় গ্রহণকারীরা হয়ে পড়ে বিচ্ছিন্ন ও আশ্রয়হীন। অস্তিত্বহীনতা, বিচ্ছিন্নতার ভয়ে তারা ভীত। তাই পুলিশ পরিত্যক্ত বাড়ি নিরীক্ষা করতে এলে তারা অস্তিত্ব রক্ষার্থে বিদ্রোহী ও প্রতিবাদী হয়ে উঠলেও একদিন এ বাড়ির গৃহকত্রীর মতোই বিতাড়িত ও উন্মুলিত হয় তারা। কিন্তু যে তুলসী গাছ নিয়ে তাদের ধর্মীয় উগ্রতা সে তুলসী গাছটি অক্ষত থেকে যায় মানবিকবোধ জাগ্রত হওয়ার কারণেই। অর্থাৎ এ গল্পে গল্পকার ব্যক্তির অন্তর্বেদনাকে, অস্তিত্বশীল হওয়ার একান্ত আন্তরিক প্রচেষ্টাকে
অঙ্কন করেছেন মানবিকতায়।
'পাগড়ি' গল্পে নিঃসঙ্গ মোতালেবের জীবন উপভোগ আকাঙ্ক্ষার রূপকল্প। উপভোগী জীবন অস্তিত্বের প্রতিষ্ঠায় সে স্ত্রীর উন্মাদনায় দ্বিতীয় স্ত্রী ঘরে আনতে মনস্থির করে। সে জীবনকে পদে পদে সম্পূর্ণভাবে উপভোগ করতে চায়। এ গল্পে গল্পকার মানুষের অবচেতন আকাঙ্ক্ষা, তার আসঙ্গলিপ্সা ও উপভৌগিক মানসিকতাকে চিত্রিত করেছেন। গল্পকার এ গল্পে মোতালেবের অস্তিত্ব জিজ্ঞাসার সাথে মানবিকতাকে সম্পৃক্ত করেছেন। 'নিষ্ফল জীবন নিষ্ফল যাত্রা' গল্পে ব্যক্তির ক্লেদাক্ত জীবনাভিজ্ঞতা থেকে শূদ্ধ অস্তিত্বে উপক্রমণের শিল্পসফল প্রকাশ লক্ষ করা যায়। নিজ্ঞান সত্তা থেকে দায়িত্বময় জ্ঞানবান সত্তায় উপনীত হলেই মানুষ অস্তিত্ববান ও মানবিক হয়ে ওঠে। এ গল্পে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ মানবিক দর্শনকেই প্রকাশ করেছেন। এ গল্পের মূল চরিত্র সদরউদ্দিনের মধ্যেও সূচিত হয়েছে সে সচেনতাও দায়িত্ববোধ। অতঃপর সে অবচেতন মনের অপরাধময় অন্ধকার জগৎ থেকে উপস্থিত হয়েছে অস্তিত্বময় মানবিক আলোর ভুবনে।
সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর প্রায় সব গল্পই এক মানবিক পরিণতি অর্জন করে অস্তিত্ববাদী দর্শন পরিচর্যার মধ্য দিয়ে সুন্দরভাবে পরিস্ফুট হয়েছে। কারণ ব্যক্তির চেতনাপ্রবাহরীতি অবলম্বন করে পরাবাস্তববাদী পরিচর্যা অন্তর বাস্তবতাকে তিনি এঁকেছেন তার গল্পে। তাই তার গল্পে অস্তিত্ববাদ দর্শন ও মানবিকতা প্রাণময় রূপলাভ করেছে। যেমন- "বাইরে তার কর্মবহুল জীবন তাকে যশ-মান- অর্থ দিলেও তার ব্যক্তিগত জীবন তাকে নির্মমভাবে বঞ্চিত করেছে ... আজ এ কথা বলতে তিনি পারবেন কি যে তিনি জীবনকে পদে পদে সম্পূর্ণভাবে উপভাগে করেছেন?"
'খুনী' গল্পে ঘাতক রাজ্জাকের অস্তিত্বশীল ও মানবিক হয়ে ওঠার কাহিনিই প্রধান হয়ে উঠেছে। চর আলেকজান্দ্রারের সোনাভাঙা গ্রামের মৌলভিদের বাড়ির বাসিন্দা সে। আকস্মিক উত্তেজনায় ফজু মিঞার ছেলে ফইন্যাকে খুন করে সে নিরুদ্দিষ্ট হয়। প্রাণের ভয় তাকে তাড়া করে বেড়ায়। এজন্য উত্তরবঙ্গের এক দর্জি আবেদ মিঞার বাড়িতে তার হারানো ছেলে মোমেনের পরিচয়ে আশ্রয় পেলেও সে অন্তরে নিরুদ্বিগ্ন হতে পারেনি। সে আসলে মোমেন হয়ে থাকতে চায়নি। রাজ্জাকরূপেই সে পরিচিত হতে চেয়েছিল। তাই খুনের কথা স্বীকার করে রাজ্জাক অস্তিত্ববান ও মানবিক সত্তায় উত্তীর্ণ হয়েছে। তার কথায়, "আমার নাম আবদুর রাজ্জাক। আলেকজান্ডর সোনাভাঙা গেরামের ফজু মিঞাদের বাড়ির ফইন্যারে আমি খুন করছি- গত চৈত্র মাসে।" তার এ আত্মস্বীকৃতির মধ্য দিয়ে তার মানবিকতাই স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ তার লেখনীর মাধ্যমে পাঠককে প্রতিটি
রচনাতে একটি তথ্য দিয়ে গেছেন। ছোটগল্পও এ ধারার ব্যতিক্রম নয়। তিনি তার রচনাতে মানবিকতায় সচেতন মানুষের কথা বলেছেন এবং মানবিক পরিণতি দান করেছেন অস্তিত্ব রক্ষার স্বার্থেই। এ বোধটিকে তিনি অতি সযত্নপ্রয়াসে গল্পের শরীরে এঁটে দিয়েছেন শিল্প এবং শিল্পীর দায়বদ্ধতা থেকে। সুতরাং মানবিক পরিণতি দানের ক্ষেত্রে তার ছোটগল্পগুলো শিল্পসফল।