তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় তার 'নারী ও নাগিনী' গল্পে “জৈব আসক্তি নয়, মানবিক হৃদয়াসক্তির এক নতুন স্তর আবিষ্কার করেছেন।"- আলোচনা কর। অথবা, 'নারী ও নাগিনী' গল্পে জৈব আসক্তি ছাপিয়ে কীভাবে মানবিক হৃদয়াসক্তি প্রাধান্য বিস্তার করেছে বিশ্লেষণ কর।
বাংলা সাহিত্যের জগতে নিম্নবর্গের মানুষের জীবনের রূপকার তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়। প্রবৃত্তি-নিবৃত্তি ঘটিত জীবনাকুতি, নিয়তির অমোঘ প্রভাবে পরিচালিত মানবজীবন, সমাজের নানা শ্রেণিবৈষম্য, নিম্নবৃত্তের অর্থনৈতিক ও মনস্তাত্ত্বিক সংকট প্রভৃতি বিষয় নিয়ে তার গল্পগুলো রচিত। মানবিক হৃদয়াসক্তির তেমনি একটি উল্লেখযোগ্য গল্প 'নারী ও নাগিনী' যেখানে তিনি মানুষকে জৈব আসক্তি উর্ধ্বে নিয়ে দেখিয়েছেন যে, কেবল নর ও নারী নয়, ইতর প্রাণীর সাথেও মানুষের গভীর সম্পর্ক গড়ে ওঠা সম্ভব।
'নারী ও নাগিনী' গল্পের কাহিনি অংশে দেখা যায়, দরিদ্র খোঁড়া শেখ দিনমজুরি ও সাপের খেলা দেখিয়ে কোনোমতে দিনাতিপাত করে। এক সময় সে ইটের পাঁজায় উদয়নাগ নামের অতি সুন্দর, বিরল প্রজাতির সাপের বাচ্চা খুঁজে পায়। ধরার পরই খোঁড়া শেখ বুঝতে পারে সাপটা পুরুষ নয়, সাপিনি। ছমাস বাড়িতে রেখে সাপটাকে বড় হয়ে ওঠার সুযোগ দেয় খোঁড়া শেখ। ইতোমধ্যে এই উদয়নাগ সাপটির সাথে খোঁড়া শেখের এক মানবিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে যা সংজ্ঞার ঊর্ধ্বে। খোঁড়া শেখের স্ত্রী জোবেদা তার স্বামীর সর্পপ্রীতির কথা জানে। কিন্তু তার অবাক হওয়ার বিষয় হচ্ছে- খোঁড়া শেখ যখন সাপটার নাকে একটা মিনি নাকফুল পরিয়ে দেয়, তাকে ঠাট্টা করে আরেক বিবির সম্মান দিয়ে মাথায় সিদুর দিয়ে দেয়। তার হাত উদয়নাগ সাপটা লেজ দিয়ে জড়িয়ে ধরার মধ্যে সাপের সংগমের কথা বললে জোবেদা বিরক্ত হয়। স্বামীকে সাবধান করে বলে, 'তোর খোলা ওই শেষ করবে, তা বুঝিস'।
কিন্তু গল্পের শেষে দেখা যায় খোঁড়া শেখকে নয়, অপমান ও হিংসার বশবর্তী হয়ে রাত দ্বিপ্রহরে সাপিনি জোবেদার পায়েই ছোবল বসায়। জোবেদার মৃত্যু হয়, খোঁড়া শেখ ফকিরি গ্রহণ করে আর তাদের বসতভিটে হয়ে ওঠে উদয়নাগের অভয়াশ্রম।
তারাশঙ্কর 'নারী ও নাগিনী' গল্পে খোঁড়া শেখের সঙ্গে তার পালিত সাপ উদয়নাগের যে সম্পর্ক বর্ণনা করেছেন তা কোনো বিশেষ সংজ্ঞায় সংজ্ঞায়িত করা দুষ্কর। ইতর প্রাণীর সাথেও যে মানুষের গভীর সম্পর্ক গড়ে উঠতে পারে তারই এক বিশ্বস্ত দলিল ও উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত এ গল্প। গল্পের নায়ক খোঁড়া শেখ পৃথিবীতে একক, পারিবারিক, সামাজিক ঐতিহ্য থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন, এক আদিম মানুষের মতো। সে আদিমতা ও বিকৃতি শুধু নামে নয়, তার বাইরের চেহারা বর্ণনাতেও বিদ্যমান। তার বাম পা ভাঙা, কুৎসিত ব্যাধিতে বাম নাকের জায়গায় বীভৎস গহ্বর, তার ওপর সারা শরীরে বসন্তের দাগে সবটাই ভয়ংকর। এমন মানুষই তো পারে আদিম বিষাক্ত সাপকে আপন করতে আদিম স্বভাব সাদৃশ্যে।
সাপুড়ে খোঁড়া শেখ সাপ খেলা দেখিয়ে রোজগার করলেও সাপকে পোষ মানানোয় তার মন এক নেশার মতো কাজ করে। আর তাতেই উদয়নাগ সাপটি পোষ্য হিসেবে খোঁড়া শেখকে বিশেষভাবে টানে। যার কারণে সাপিনিটির সাথে তার হৃদয়ের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। এ সাপিনিকে সে সাজায়, আদর করে, তাকে পোষ মানানোয় আনন্দ পায়; তাকে চুম্বন করে নির্দ্বিধায়। এমনকি সে সাপ নিয়ে যেমন খেলা দেখায়, তেমনি নিজেও সাপিনিকে নিয়ে ব্যক্তিগত খেলায় মাতে। এখানে তার নেশা কৌতুকে ভরে ওঠে। তাই-"খোঁড়া সুকৌশলে বিবিকে ধরিয়া একটি কাঠির ডগায় সিঁদুর লইয়া সাপটির মাথায় একটি লাল রেখা আঁকিয়া দিল। তারপর হা হা করিয়া হাসিয়া বলিল, ওয়াকে আমি নিকা করলাম জোবেদা, ও তোর সতীন হল।"
শুধু তাই নয়, সাপিনি যখন খোঁড়া শেখের হাত পেঁচিয়ে ধরে তখন খোঁড়া এটিকে সাপ আর সাপিনীর সংগমের সাথে তুলনা করে বলে-“দেখ দেখ কেমন আমার হাতটা জড়িয়ে ধরেছে, দেখ দেখি। জানিস! সাপিনী আর সাপে যখন খেলা করে, তখন ঠিক এমনই ধরে জড়াজড়ি করে ওরা। দেখেছিস কখনও? আঃ! সে যে কি বাহারের খেলা মাইরি!
কিশোর সাপিনির খোঁড়া শেখের আদরে, ভালোবাসায় পোষ্য হয়ে তার পুরুষ হাত জড়িয়ে থাকা-এখানেই বুঝা যায় আস্তে আস্তে সাপিনি এক পুরুষের সান্নিধ্যে অন্য স্বাদে বা প্রাণে নতুন হয়।
নাগিনীর সঙ্গে খোঁড়া শেখের যে সম্পর্ক ছিল খেলার ও কৌতুকের, তা ক্রমশ সরে গিয়ে সম্পর্কের মধ্যে চাপা মনস্তাত্ত্বিক দায়িত্ব বেড়েছে। নাগিনীর সাথে খোঁড়া শেখের বিচ্ছেদেই তা প্রমাণিত হয়। দুরন্ত বর্ষার দিনে সাপিনির গা থেকে যখন সংগম করার জন্য বিশিষ্ট গন্ধ বের হয়, তখন খোঁড়া সাপিনিকে পুরুষ সাপের সাথে মিলিত হওয়ার জন্য দূরের মাঠে ছেড়ে দিয়ে আসে। কিন্তু সাপিনিকে মাঠে ছাড়ার পর থেকে খোঁড়া শেখের মন বিষণ্ণ হতে থাকে। স্ত্রী জোবেদার সঙ্গ, আদর, চুম্বনও সে বিষণ্ণতা দূর করতে পারে না। এখানেই তারাশঙ্কর খোঁড়া শেখের মানবিক হৃদয়াসক্তির এক নতুন স্তর আবিষ্কার করেছেন। আদরে-চুম্বনে স্ত্রীর প্রতি জীবনের গভীরতম ভালোবাসার কথা জানানোর সময়েও খোঁড়া শেখ সাপিনির প্রতি গভীর টানের কথা বলে। এ গভীর টান যে কেবলমাত্র খোঁড়া শেখের একপাক্ষিক তা কিন্তু নয়। তার পোষা সাপিনিটিও তার প্রতি গভীর টান অনুভব করে। যার কারণে সংগমের জন্য সাপিনিকে মাঠে ছেড়ে দিয়ে আসা হলেও সেটি অপরাহে আবার ফিরে আসে।
সাপিনি ফিরে এলেও জোবেদা সাপিনিকে তাড়াতে থাকে এবং একখানা ঘুঁটে ছুড়ে মারলে রাগে সাপিনি ফণা তুলে মাটিতে ছোবল মারতে মারতে চলে যায়। সাপিনির কাছে খোঁড়া শেখের নৈকট্য লাভের পথে একমাত্র বাধা হয়ে দাঁড়ায় জোবেদা। আর তাইতো রাত দ্বিপ্রহরে সেই সাপিনিই ফিরে আসে অন্ধকারে, ঘুমন্ত জোবেদার পায়ে ছোবল বসায়। নাগিনীর ছোবলে জোবেদা চরম অসুস্থ হয়ে পড়লে খোঁড়া নাগিনীর উদ্দেশে বলে-“জোবেদা যদি না বাঁচে, তবে তোকেও শেষ করব আমি।”
কিন্তু গল্পের শেষে দেখা যায়, জোবেদা মারা গেলেও খোঁড়া শেখ সাপিনিকে কিছুই করে না, ছেড়ে দেয়। আর এখানেই গল্পকারের বিশেষ ভাবনা ও জীবনদর্শনের সন্ধান পাওয়া যায়। অর্থাৎ কেবল নর ও নারী নয়, ইতর প্রাণীর সাথেও যে মানুষের গভীর সম্পর্ক গড়ে উঠতে পারে তার বিশ্বস্ত দলিল ও উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত এই 'নারী ও নাগিনী' গল্প।