তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'তারিণী মাঝি' গল্পের শিল্পরূপ আলোচনা কর। অথবা, 'তারিণী মাঝি' গল্পের শিল্পমূল্য নিরূপণ কর।
ঔপন্যাসিক প্রতিভা তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় বাংলা
ছোটগল্পের জগতেও সমভাবে কীর্তিমান। কেবল তার কালিক প্রেক্ষাপটেই নয়, বর্তমানকালের বিচারেও তারাশঙ্করের এ অপ্রতিমতা সমধিক লক্ষণীয়। ব্রাত্য মানুষের আদিম জৈবচেতনার কুণ্ঠাহীন উপস্থিতি তার অনেক গল্পে বিশেভাবে লক্ষণীয়। জৈবচেতনার গল্প হিসেবে তারিণী মাঝি এক বিস্ময়কর সৃষ্টি। রাঢ় বাংলার রুক্ষ মাটিতে জীবনসংগ্রামরত গ্রামীণ লোকালয় শতধারায় শিল্পিত হয়েছে বস্তুত নিস্পৃহ প্রকৃতির সামনে মানুষের হৃদয় কতটা অসহায় তারই চিত্র শিল্পিত রূপে ফুটে উঠেছে 'তারিণী মাঝি' গল্পে।
'তারিণী মাঝি' বাংলা ছোটগল্পের ধারায় এক অসামান্য নির্মাণ। জৈবচেতনার এবং বেঁচে থাকার অন্তহীন আকাঙ্ক্ষায় 'তারিণী মাঝি' একই সঙ্গে অন্তরানন্দ, রহস্যময় জীবনসত্য, অস্তিত্বের আদিম বাসনা এবং অতল-অতুল হার্দ্য-রক্তক্ষরণের শিল্প প্রতিমা। জীবনের কঠোর এবং কোমল-দুরূপই 'তারিণী মাঝি' গল্পে উন্মোচিত।
'তারিণী মাঝি' গল্পের প্রধান চরিত্র তারিণী ময়ূরাক্ষী নদী তীরবর্তী
গণুটিয়া ঘাটে খেয়া পারাপার করে জীবিকানির্বাহ করে কোনোক্রমে।
একই কাজে তার সঙ্গী কালাচাঁদ, আর ঘরে আছে নিঃসন্তান
প্রিয়তমা স্ত্রী সুখী। তারিণীর সংগ্রামশীল জীবনে প্রাচুর্য না থাকলেও
সুখশান্তির কোনো অভাব ছিল না। তন্বী, উচ্ছল, উজ্জ্বল, শ্যামবর্ণা,
সুন্দরী সুখীর জন্য তারিণীর আনন্দের সীমা ছিল না। সুখীও
তারিণীর প্রতি ছিল গভীরভাবে আকৃষ্ট, স্বামীর প্রতি তার ভালোবাসা
ও বিশ্বাস ছিল অটল। সুখীর মতো ময়ূরাক্ষীর সঙ্গেও তারিণীর
সম্পর্ক অচ্ছেদ্য। ময়ূরাক্ষীই বাঁচিয়ে রেখেছে তারিণীকে, ময়ূরাক্ষীর
স্রোতোধারা থেকেই সে পেয়েছে বেঁচে থাকার সঞ্জীবনী মন্ত্র।
তারিণী ময়ূরাক্ষীকে জীবনদাত্রী জননী বলেই জানত। কিন্তু
একদিন এই জীবন পালিনী ময়ূরাক্ষীই তারিণী ও সুখীর জীবনে
দেখা দেয় ভয়ংকর রাক্ষসী রূপে।
ময়ূরাক্ষীকে হড়পা বানে তাদের ঘর ছাড়তে হয়। জলমগ্ন অবস্থার ক্রমেই বাড়তে থাকা হড়পার জলে নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে চলে এ দুই মানব মানবী। তারিণীর কোমর ধরে থাকে সুখী, স্বামীর প্রতি অগাধ বিশ্বাস আর ভরসায় ভর করে তারা নিরাপদ ভূমির সন্ধানে অগ্রসর হতে থাকে। কিন্তু দৈব-দুর্বিপাকে তারা পড়ে যায় ময়ূরাক্ষী নদীর গর্ভে। এরপর শুরু হয় তারিণীর জীবনসংগ্রাম, অনিবার্য মৃত্যুর ছোবল থেকে নিজেকে এবং প্রিয়তমা স্ত্রীকে রক্ষা করার আকুল সংগ্রাম। কিন্তু একসময় তারা পড়ে যায় ময়ূরাক্ষীর ঘূর্ণিতে। তারিণীর সব চেষ্টা ব্যর্থ হয়ে ক্রমশ তারা তলিয়ে যেতে থাকে। সুখীর দৃঢ় বন্ধনে তারিণীর দেহও অসার হয়ে আসে, সুখীর বন্ধন থেকে নিজেকে মুক্ত করতে আপ্রাণ চেষ্টা করে তারিণী, ব্যর্থ হয়ে অবশেষে সমস্ত শক্তি দিয়ে দুহাতে চেপে ধরে সুখীর গলা, খসে যায় পাথরের মতো দুর্বার সুখী। জীবন সত্যের অপার রহস্য উন্মোচন করে মাতৃরূপী ময়ূরাক্ষীর জলে ভেসে ওঠে আলো ও মাটি প্রত্যাশী তারিণী মাঝি। এ ঘটনাংশ নিয়েই গড়ে উঠেছে তারাশঙ্করের বিখ্যাত গল্প 'তারিণী মাঝি'।
'তারিণী মাঝি' গল্পে শিল্পিত হয়েছে শাশ্বত ও চিরকালীন জীবধর্মের জয়। চরম মুহূর্তে মানুষের কাছে আপন জীবন ছাড়া অন্যকিছুই প্রিয়তর নয়-কর্তব্যবোধ, ভালোবাসা, দাম্পত্য সম্পর্ক কিছুই নয়। এ অন্ধ জৈবধর্মের জয়ই এ গল্পে রূপায়িত।
চরিত্র সৃষ্টিতে তারাশঙ্করের শ্রেষ্ঠত্ব তার আঞ্চলিকতায় এবং সহানুভূতিতে। তার গল্প বিচিত্র চরিত্রের চিত্রশালা হলেও সেখানে পুরুষেরাই দলে ভারী। 'তারিণী মাঝি' গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র তারিণী ময়ূরাক্ষী নদীর গনুটিয়া ঘাটের খেয়া পারাপারের মাঝি। তারাশঙ্কর গল্পের প্রথমদিকে তারিণী চরিত্রের নানা গুণের কথা উল্লেখ করেছেন। কৌতুকময়তা, মানব কল্যাণকামী দৃষ্টিভঙ্গি, পরোপকার বৃত্তি, পত্নীপ্রেম, সততা-এসব ইতিবাচক গুণের অধিকারী তারিণী। তারাশঙ্কর সতর্কতার সাথে তারিণী চিত্রে পত্নীপ্রেমের প্রসঙ্গ উল্লেখ করেছেন। গল্পের পরিণতিকে ব্যঞ্জনাময় ও নিগূঢ় করার জন্য সুখীর প্রতি তারিণীর ভালোবাসাকে পরম মমতায় প্রকাশ করেছেন তিনি। ঘোষ বধূকে নদীর গ্রাস থেকে রক্ষা করে বউয়ের জন্য ফাঁদি, নথা পাওয়ার পরও ঘোষ মহাশয় যখন তাকে আরও কিছু দিতে চাইলেন, তখন প্রকাশ পেল বউ সুখীর জন্য তারিণীর গভীর প্রেম। "তারিণী কৃতজ্ঞতায় নত হইয়া প্রণাম করিয়া কহিল, আজ্ঞে হুজুর, চাদরের বদলে যদি শাড়ি -"
গল্পের সমাপ্তিতে তারিণীর জীবনাকাঙ্ক্ষাকে নিগূঢ় করার জন্য সুখীর প্রতি তার ভালোবাসার ছবি অঙ্কন করা ছিল অনিবার্য। যে স্ত্রীর প্রতি তার এত ভালোবাসা, তাকেই হত্যা করে সে আলো আর মাটির সন্ধান পেয়েছে। নির্মম সেই প্রাপ্তি তবু তখন তারিণীর জীবনে নিগূঢ় সত্য।
তারিণীর যোগ্য সহধর্মিণী সুখী গল্পের রক্তমাংসের মানবী নায়িকা।
তারাশঙ্কর সহানুভূতির কোমল রসদৃষ্টিতে তাকে গড়েছেন। এজন্য
সে শান্ত, ধীরস্থির, যুক্তিপরায়ণ। সে না থাকলে সত্যি তারিণীর
হাড়ির ললাটে ডোমর দুর্গতি হতো। গৃহিণী সচিব, সুখীর
ভূমিকায় যথার্থই সে সহধর্মিণী। তারিণীর খাওয়া-দাওয়া, রোগ-
ব্যামো, বিপদ-আপদ সম্পর্কে সে সর্বদাই সজাগ। আবার বানে ভেসে আসা জিনিস ধরা নিয়ে সহকর্মী কালাচাঁদের সাথে তারিণীর বিবাদের উপক্রম হলে সুখী মধ্যস্থলে দাঁড়িয়ে সব মিটিয়ে দেয় সহজ যুক্তিতে। হড়পা বানের চরম বিপদের সময়ও প্রাণের এক রকম বিশ্বাস নির্ভরতায় স্বামীকে আশ্রয় করে সে জলে ভেসেছিল এবং মৃত্যুর আগ পর্যন্ত সে বিশ্বাস ছিল অটুট।
তারিণী চরিত্রকে পূর্ণতা দানের আকাঙ্ক্ষায় গল্পে সাবি ও কালাচাঁদ চরিত্রের অবতারণা। সাবি মুখরা পল্লিরমণী হলেও বুদ্ধিমতি ও হাস্যপরিহাসে পটু। অন্যদিকে, কালাচাঁদ ওরফে কেলে তারিণী মাঝির 'সহকারী' আদিম অমার্জিত স্বভাবের নেশাখোর মানুষ। তারিণীর মতো দক্ষ মাঝি সে নয়, পরিহাসপটুও নয়, তবে তার রসবোধ আছে, আর আছে অন্নদাতার প্রতি কৃতজ্ঞতা।
তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় গল্পের পরিণতিকে আভাসিত করার জন্য অসামান্য নৈপুণ্যে পরিপ্রেক্ষিতের ব্যবহার করেছেন। একটি বাক্যের সাহায্যে তিনি পরিণতিকে ইঙ্গিতময় করে তুলেছেন ময়ূরাক্ষীর বর্ণনায়- "লগির খোঁচা মারিয়া তারিণী বলিল, হরি হরি বল সব-হরিবোল। যাত্রীর দল সমস্বরে হরিবোল দিয়া উঠিল- হরিবোল। দুই তীরের বনভূমিতে সে কলরোল প্রতিধ্বনিত হইয়া ফিরিতেছিল। নিম্নে খরস্রোতা ময়ূরাক্ষী নিম্নস্বরে ক্রুর হাস্য করিয়া বহিয়া চলিয়াছিল।" এই ক্রুর ভয়ংকরী রাক্ষসী ময়ূরাক্ষীর প্রেক্ষাপট তারিণীর ভবিষ্যৎ বিপর্যয়ের পূর্বাভাস।
এ গল্পে তারাশঙ্কর ময়ূরাক্ষী নদীকে নিগূঢ় সাংকেতিকতায় ব্যবহার করেছেন। একদিকে সে জীবন পালিনী, মাতৃরূপিণী, অন্যদিকে ভয়ংকর রাক্ষসী। নদীর এ দ্বৈতসত্তা যেন মানবজীবনের বিপ্রতীপ
প্রবণতার নিগূঢ় সংকেত।
চরিত্রের মনোলোক এবং কেন্দ্রীয় প্রবণতা উন্মোচনের জন্য গল্পকার তারাশঙ্কর এ গল্পে কিছু সুপ্রযুক্ত নিপুণ অলংকার নির্মাণ করেছেন। ময়ূরাক্ষী নদীর স্বভাব বৈশিষ্ট্য এবং নদীর সাথে তারিণী মাঝির সম্পর্কের স্বরূপ বর্ণনার জন্য লেখক উপমার ব্যবহার করেছেন-
i. বর্ষার প্রারম্ভে সে রাক্ষসীর মতো ভয়ংকরী।
সমাসোক্তি: তারিণীর অট্টহাসিতে বর্ষার রাত্রির সজল অন্ধকার
ত্রস্ত হইয়া উঠিল।
উৎপ্রেক্ষা : দুর্ভিক্ষ যেন দেশের মাটির তলেই আত্মগোপন করিয়া ছিল।
আলোচ্য গল্পে তারাশঙ্কর রাঢ় বাংলার প্রচলিত একাধিক প্রবাদ ব্যবহার করেছেন। যেসব প্রবাদ তার কৌতুকময় মানসিকতা প্রকাশে পালন করেছে অব্যর্থ ভূমিকা। যেমন- লাজে না কুঁকড়ি, ঝোপের ধুকড়ি ও হাড়ির ললাটে ডোমের দুর্গতি।
তারিণী মাঝি গল্পে তারাশঙ্করের মৌল উদ্দেশ্য মানুষের আদিম জৈবপ্রবৃত্তির বিজয় ঘোষণা। সমাজ বাস্তবতার ছবি হিসেবেও 'তারিণী মাঝি' একটি উল্লেখযোগ্য গল্প হিসেবে উত্তরকালীন পাঠকের কাছে বিবেচনাযোগ্য।
বাংলা ছোটগল্পের ধারায় তারাশঙ্করের 'তারিণী মাঝি' এক উজ্জ্বল নির্মাণ। মানবপ্রবৃত্তির অতলান্ত রহস্যময়তা এ গল্পে নাটকীয় ব্যঞ্জনায় শিল্পরূপ লাভ করেছে। তারিণীর অন্তিম আচরণের মধ্য দিয়ে আমরা মানুষের ওপর নিয়তিরূপ প্রবৃত্তির আমোঘ লীলাখেলা উপলব্ধি করি, লক্ষ করি জৈবধর্মের শাশ্বত বিজয়গাথা।