তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'অগ্রদানী' গল্পের নামকরণের সার্থকতা বিচার কর। অথবা, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধায়ের 'অগ্রদানী' গল্পের নামকরণের সার্থকতা আলোচনা কর

তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের অগ্রদানী গল্পের নামকরণের সার্থকতা বিচার কর। অথবা, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধায়ের অগ্রদানী গল্পের নামকরণের সার্থকতা আলোচনা কর
বাংলা সাহিত্যের ছোটগল্পের ধারায় তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। রাঢ় অঞ্চলের প্রাকৃতিক পরিবেশ, গ্রামীণ সমাজজীবন ও মানুষের বিচিত্র চরিত্রের রূপায়ণ ঘটেছে তার ছোটগল্পে। তার প্রায় সব গল্পেই আদিম সংস্কার রূপের নগ্ন প্রকাশ উপস্থাপিত। তার ছোটগল্পে জনজীবনের আদিম অন্ধসংস্কার, বিশ্বাস, রহস্যময়তা ইত্যাদি শিল্পনিপুণতার সাথে প্রকাশিত। তার 'অগ্রদানী' এমনই এক গল্প যেখানে অমোঘ বিধানের নির্মম ট্র্যাজেডির মহাভয়ংকর আলেখ্য চিত্রিত। গল্পের নামকরণের ক্ষেত্রেও তিনি সার্থকতার পরিচয় দিয়েছেন।
সাধারণভাবে গল্পের কাহিনিসংস্থান ও ভাবধর্মিতা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, বিষয়বস্তু, কেন্দ্রীয় চরিত্র, কাহিনির কেন্দ্রস্থল বিরাজিত সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা রচয়িতার উপলব্ধিগত জীবন সত্য, লেখকের সৃষ্টি ভাবনার দ্যোতক কোনো প্রতীক প্রভৃতি যেকোনো একটিকে অবলম্বন করে স্রষ্টা তার সাহিত্যকর্মের নামকরণ করেন। সৃষ্টিশীল রচনার কেন্দ্রবিন্দু সম্পর্কে সচেতন পাঠককে আভাস প্রদানের ইচ্ছাও নামকরণের অন্যতম শর্ত। 
তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'অগ্রদানী' গল্পটি পূর্ণ চক্রবর্তীর অগ্রদানী ব্রাহ্মণে পরিণত হওয়ার কাহিনি এবং তার অন্তিম ফলশ্রুতিতে। ব্যক্তিজীবনের মর্মন্তুদ ট্র্যাজেডিকে কেন্দ্র করে 'অগ্রদানী' গল্পের সূচনা, ব্যাপ্তি ও পরিণতি। সুতরাং গল্পের নামকরণ যেমন পূর্ণ। চক্রবর্তীকেন্দ্রিক, তেমনি তার অগ্রদানীতে পরিণত হওয়ার ফলে জীবনে যে অমোঘ নিয়তির নির্মম বিধান নেমে আসে তাকে কেন্দ্র করেও বটে। মৃত ব্যক্তির শ্রাদ্ধ কার্যের সময় প্রেতের উদ্দেশে উৎসর্গীকৃত দান যে ব্রাহ্মণ অগ্রে গ্রহণ করে এবং পিন্ড ভোজন করে তাকে অগ্রদানী বলা হয়। এই শ্রেণির ব্রাহ্মণ প্রেত সম্পাদনের দান গ্রহণ করে বলে সমাজে পতিত ব্রাহ্মণরূপে পরিগণিত। অথচ অগ্রদানী ব্রাহ্মণ না হলে শ্রাদ্ধও সফল হয় না। তাই গল্পের এরূপ নামকরণের মাধ্যমে গল্পকার তার সৃষ্টির বিশেষ উদ্দেশ্যকে প্রতিফলিত করে। 
'অগ্রদানী' গল্পে পূর্ণ চক্রবর্তী নামে এক উদরসর্বস্ব, পরান্নলোভী, নির্লজ্জ, দীনচিত্ত ব্রাহ্মণের অদৃষ্টের করুণ কাহিনি বর্ণিত হয়েছে। গল্পটির কেন্দ্রীয় চরিত্র পূর্ণ চক্রবর্তী কিন্তু পূর্ণ চক্রবর্তী, অর্থাৎ কেন্দ্রীয় চরিত্রের চরিত্র চিত্রণ গল্পের মৌল বিষয় নয়। যদি উদ্দেশ্য তাই হতো তবে কেন্দ্রীয় চরিত্রের নামে নামকরণ হতো, যেমনটি হয়েছিল 'তারিণী মাঝি' গল্পে। লোভের অপ্রতিরোধ্য আকর্ষণ কীভাবে পূর্ণ চক্রবর্তীকে নীতিবোধবিবর্জিত ব্যক্তিতে পরিণত করেছে এবং তার অস্বাভাবিক চরিত্র কীভাবে তাকে পরিণতিতে মহাভয়ংকরত্বের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে, কী ভয়ংকর শোচনীয় পরিণামে পাঠকচিত্ত শিহরিত হয়েছে লেখক সেই অন্তিম ঘটনাকেন্দ্রিক নামকরণও করেননি। গল্পের নামকরণের ক্ষেত্রে লেখক এমন একটি শব্দ নির্বাচন করেছেন, যার মাধ্যমে কেন্দ্রীয় চরিত্রের আদিম জৈবিক সর্বগ্রাসী লোভ ও তার ভয়ংকর পরিণতি চিত্ত আলোড়নকারী পরিণামী ব্যঞ্জনায় ব্যঞ্জিত হয়েছে।
চক্রবর্তী প্রথম জীবন থেকেই অগ্রদানী ব্রাহ্মণ ছিল না, উদ্দিরিক লোভের বশবর্তী হয়ে সে অগ্রদানী ব্রাহ্মণ হয়েছে। চক্রবর্তীর পুত্র বদলের সাংঘাতিক ঘটনার প্রায় দশ বছর পর শ্যামাদাস পত্নী শিবরাণীর মৃত্যু হলে, শ্রাদ্ধের জন্য অগ্রদানী ব্রাহ্মণ পাওয়া যাচ্ছিল না, অথচ অগ্রদানী ব্যতীত শ্রাদ্ধ সফল হয় না। তখন পূর্ণ চক্রবর্তীকে অগ্রদানী হওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হয় এবং বিনিময়ে শ্যামাদাস বাবু তাকে পঁচিশ বিঘা জমি ও বছরে পঞ্চাশ টাকা জমিদারি সম্পত্তির মুনাফা প্রদানে প্রতিশ্রুত হলেন। যদিও পূর্ণ চক্রবর্তী আপন সন্তানের বিনিময়ে পূর্বে শ্যামাদাস বাবুর কাছ থেকে দশ বিঘা জমি ও সিংহবাহিনীর প্রসাদ লাভ করেছিল, তবুও সে লোভ সংবরণ করতে পারেনি। শ্রাদ্ধের দিন আপন পুত্রের হাত থেকে জমিদার পত্নীর পিন্ড গ্রহণ করে ভোজন করার ফলে সে 'অগ্রদানী' ব্রাহ্মণে পরিণত হয়। অগ্রদানী ব্রাহ্মণে পতিত্যবরণের ফলে যে হীনতাবোধের জন্ম হয় তা পূর্ণ চক্রবর্তীর ছিল না। আসলে তার খাদ্যলোলুপতাই তাকে অগ্রদানীতে পরিণত করেছে। কারণ- "লোভী, আহার-লোলুপ চক্রবর্তীর আপন সন্তানের হাতে পিন্ড ভোজন করিয়াও তৃপ্ত হয় নাই। লুব্ধ দৃষ্টি, লোলুপ রসনা লইয়া সে তেমনই করিয়াই ফিরিতেছিল।
জৈবিক তাড়নায় পূর্ণ চক্রবর্তীর মনুষ্যত্ববোধ আচ্ছন্ন ছিল। ভোজনের সন্ধান পেলে সে বিনা নিমন্ত্রণে সেখানে হাজির হতো। গৃহকর্তার পক্ষ থেকে স্বেচ্ছায় গ্রাম ঘুরে ঘুরে নিমন্ত্রণ করে আসত। লোভের তাড়নাতে সে মুমূর্ষু শিশুপুত্রের সাথে নিজের সুস্থ সন্তানের বদল ঘটিয়েছিল। স্ত্রী-পুত্রকে বঞ্চিত করে মিষ্টান্ন গ্রহণে যে ইতস্তত করতো না। 
প্রকৃতপক্ষে লোভের কারণেই পূর্ণ চক্রবর্তীর পাপের পথে চক্রযান এবং আপন পুত্রের হাতে অগ্রদানী পিণ্ড ভক্ষণের ন্যায় ভয়ংকর পরিণতিভোগী। তারপরও চক্রবর্তীর লালসার নিবৃত্তি হয়নি। এর চৌদ্দ বছর পরে শ্যামাদাস বাবুর বংশধররূপী তার নিজের পুত্রের অকাল মৃত্যুতে তার পিন্ড ভক্ষণের ভয়াবহ সম্ভাবনায় বিপর্যন্ত ও বিচলিত চক্রবর্তী অন্নদাতার কাছে করুণ আর্তনাদ জানায়, 'পারব না বাবু, আমি পারব না।" কিন্তু তার সমস্ত আবেদন ব্যর্থ হয়। শ্যামাদাস বাবু বলেন, "তুমি পারবে না বললে চলবে কেন, বল? দশ বিঘে জমি তুমি এতেও পাবে।" 
জমিদারের অন্নদাস হয়ে সে যে অগ্রদান বৃত্তি গ্রহণ করেছিল তাই তাকে অতলান্ত বিপর্যয়ের সর্বশেষ সীমায় নিয়ে গেছে। শ্রাদ্ধের দিন শ্যামাদাস বাবুর বংশধরের বিধবা স্ত্রী থেকে অর্থাৎ আপন পুত্রবধূর হাত থেকে নিজ পুত্রের পিন্ড গ্রহণ করতে হয়েছে এবং পুরোহিতের 'খাও হে চক্রবর্তী' সংলাপে যেন নিয়তির চরম বিধানের অতর্কিত মহাবাণী উচ্চারিত হয়েছে, যা চক্রবর্তীর ট্র্যাজেডিকে ষোলো আনা পূর্ণ করেছে; অগ্রদানীর দীর্ঘ হাত প্রসারিত করে তাকে মৃত পুত্রের পিন্ড গ্রহণ করতে হয়েছে। অগ্রদানী নামকরণে এই ভয়ংকর পরিণাম প্রতিফলিত। সুতরাং অগ্রদানীর ব্যঞ্জনা হলো পরিণামবাহী ব্যঞ্জনা।
'অগ্রদানী' নামকরণ গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র ও তার করুণ পরিণতির ঘটনা উভয়ের প্রতি অঙ্গুলিনির্দেশ করে। তাই গল্পের আবহমণ্ডলে এ জাতীয় নামকরণ সার্থক হয়ে উঠেছে। ‎‫
আপনারঅদৃশ্যমন্তব্য
Cancel