'পুতুল নাচের ইতিকথা' উপন্যাস অবলম্বনে মনুষ্য- জীবনে নিয়তির প্রভাব আলোচনা কর। অথবা, 'পুতুল নাচের ইতিকথা' উপন্যাস অবলম্বনে মনুষ্য জীবনে নিয়তির ভূমিকা প্রসঙ্গে ঔপন্যাসিকের দৃষ্টিভঙ্গি আলোচনা ব্যাখ্যা কর।
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় বাংলা সাহিত্যে বিজ্ঞানমনষ্ক ও যুক্তিবাদী লেখক। তার উপন্যাসের বিষয় হিসেবে প্রাধান্য পেয়েছে মানব মনস্তত্ত্বের নানা অনুন্মোচিত প্রান্ত, রোমান্টিক ভাবাবেগ, মনোবিকার এবং বিকারের উৎস। মানব মনের চেতন, অবচেতন ও অচেতন প্রাপ্ত আশ্রয়ী জীবন অভীক্ষা, সর্বযৌনবাদে আস্থাস্থাপন, জীবন বাস্তবতার অনুসন্ধান ইত্যাদি। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় মূলত সৃজনশীল শিল্পী। 'পুতুল নাচের ইতিকথা' তার শ্রেষ্ঠ উপন্যাস। বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে এ উপন্যাসের কাহিনি বিশ্লেষিত।
'পুতুল নাচের ইতিকথা' উপন্যাসের শুরু হয়েছে হারু ঘোষের মৃত্যু দিয়ে। মৃত্যু দিয়ে শুরু করে মানিক জীবনের কথা বলেছেন। আর মাটির টিলার ওপর ওঠে শশী ডাক্তারের সূর্যাস্ত দর্শনের শখের অতৃপ্ততা দিয়ে উপন্যাসের সমাপ্তি। এরই মধ্যে দশ বছরের কাল পরিসরে তৈরি হয়েছে বিভিন্ন চরিত্রের আত্মসৃষ্ট, নিয়তির প্রতি আত্মসমর্পণ ও বিদ্রোহের ইতিকথা। উপন্যাসে দেখা যায়, বাসুদেব বাড়ুজ্জের নাতি ভূতো জামগাছ থেকে পড়ে মারা যায়। শশীদের বাড়িতে আশ্রিতা মেয়ে ক্ষেমী আঁতুড়ঘরে ঢুকে নিউমোনিয়ায় মারা যায়। সেনদিদি মারা যায় একটি ছেলে প্রসব করে। তার আগেই তার স্বামী যামিনী কবিরাজ মারা গিয়েছিল শীতের প্রকোপ সহ্য করতে না পেরে। তাছাড়া সূর্যবিজ্ঞানে বিশেষজ্ঞ যাদব পণ্ডিত সস্ত্রীক আত্মহত্যা করে। মতি কুমুদের সাথে অনির্দিষ্টের পথে যাত্রা করে। আর্টিস্ট স্বামী বনবিহারীকে নিয়ে জয়া দাম্পত্য জীবনে অসুখী। শশীর বাবা গোপাল সব ছেড়ে কাশী গমন, শশীর গ্রামে থাকা, কুসুমের গাওদিয়া ছেড়ে যাওয়া ঘটনাগুলো বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়- মানুষ নিজেই নিজের নিয়ন্ত্রক।
শশীর অনেক ছোট ছোট সংকল্প দিনে দিনে প্রবল হয়ে উঠেছিল। এক সময় সে গ্রাম ছেড়ে কলকাতায় যাবে, শেষ পর্যন্ত তার ইচ্ছেটিও ব্যর্থ হয়ে যায়। উপন্যাসটির সব মানুষের সব চেষ্টারই এক রকম আকস্মিক ব্যর্থ পরিণতি ঘটে। এ উপন্যাসে মানুষের হাহাকার অনেক বেশি। এখন প্রশ্ন হচ্ছে মানুষের এই যে পরিণাম ব্যর্থতা, তার পিছনে নিয়তি কাজ করে, নাকি মানুষই মানুষের নিয়ামক। অর্থাৎ অলৌকিক কোনো শক্তি মানুষের নিয়তিকে পূর্বে নির্ধারণ করায় মানুষ ধীরে ধীরে সেই পরিণতির দিকে এগিয়ে যায়, নাকি মানুষ তার স্বীয় ইচ্ছা চরিতার্থ করতে গিয়ে ব্যর্থ পরিণতি ডেকে আনে। অনেকে এ উপন্যাসে ঈশ্বর প্রদত্ত নিয়তিবাদ খুঁজে পেয়েছেন অনন্তর কথায়। কুসুমের বাবা অনন্ত শশীকে বলেছিলেন, "সংসারে মানুষ চায় এক, হয় আর, চিরকাল এমনি দেখে আসছি ডাক্তার বাবু। পুতুল বইতো নই আমরা, একজন আড়ালে বসে খেলাচ্ছেন।" শিল্পী সমগ্র উপন্যাসে জীবনের যে প্যাটার্ন বুনেছেন, তাতে এ কথাটা ফুটে ওঠে যে মানুষের সমস্ত চেষ্টাও নিষ্ক্রিয়তায় গিয়ে পৌছায়, ব্যর্থ হয়। একথা গোপাল, শশী, কুসুম, বিন্দু, সেনদিদি, যামিনী কবিরাজ, যাদব পণ্ডিত সব প্রধান ও অপ্রধান চরিত্রের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। এরা কেউই নিজের জীবনকে নিজের অভিপ্রায় মতো গড়ে তুলতে পারেনি বা গড়তে গিয়ে নিজেকে বিনাশ করেছে।
শশী ও কুসুম সম্পর্কটি মানবিকতার দিক থেকে যতই সমর্থনযোগ্য হোক না কেন, তৎকালীন গ্রামীণ সমাজ বাস্তবতায় তার বাস্তব রূপদান সত্যিই দুরূহ। এখানে শশীর টানাপোড়েন নিয়তির সঙ্গে বাস্তবতার নয়; বরং বাস্তবতার সঙ্গে বাস্তবতার টানাপোড়েন। একদিকে মনের অবচেতন জগতের আহ্বান। অন্যদিকে, ঐ মনেই শেকড় গেঁড়ে সমাজসত্য।
খুব ছোট পরিসরে হলেও শশীর ভগিনী বিন্দুর পরিণতিকে নিয়তির খেলা মনে হলেও তা যথেষ্ট কার্যকারণ সূত্রে বিচারযোগ্য। কারণ শশীর বাবা গোপালের শঠতা, প্রতারণা আর গোঁয়ারতুমির ফলেই বিন্দুকে নন্দের রক্ষিতা হতে হয়। তাই স্বাভাবিক পরিবেশে ফিরে আসলেও সে স্বাভাবিক হতে পারেনি। অভ্যস্ততা নামক ব্যাধিতে ততদিনে সে আক্রান্ত হয়ে গেছে। ঔপনিবেশিক সামন্ত শাসকের আরেকটি দৃষ্টান্ত পাওয়া গেল নন্দের মধ্যে এবং বিন্দুর পরিণতিতে। তাই বিন্দুর পরিণতি অলৌকিক বা নিয়তিনির্ভর নয়; বরং মানবসৃষ্ট।
কুমুদ-মতির জীবনের গল্প নিয়তির বিপক্ষে দাঁড়িয়ে মানুষ হয়ে ওঠার গল্প। যাত্রাদলের প্রবীর কুমুদ কেবল সত্যিকেই জয় করল না; বরং শশীর বন্দিত্বকেও প্রকটিত করে তুলেছে। কুমুদ ও মতির পারস্পরিক মনোজগতের ক্রিয়াশীল সম্পর্ক নিজেদের তৈরি। সেটি কেউ তাদের ওপর আরোপ করেনি; বরং তা কুমুদেরই সৃষ্ট যাযাবর প্রকৃতির জীবন মতিকে নিজের মতো করে সঙ্গী করে অনির্দিষ্টের পথে যাত্রা করেছে। এখানে জীবনের পথ তারা নিজেরাই বেছে নেয়। বনবিহারী আর জয়ার সম্পর্কটাও নিজেদের প্রেমের ফল। স্বপ্ন, কল্পনা আর বাস্তবতা এক নয়। জয়ার প্রেমের অসুখী জীবনটি তার নিজেরই সৃষ্ট। যুগের প্রেক্ষাপটে লেখকের মানসিকতা অনুসারে কোনো বিশেষ রচনার নিয়তিবাদ আসতেই পারে। কিন্তু পুতুল নাচের ইতিকথায় চরিত্রগুলো নিয়তিতে নিজ হাতে সৃষ্টি করেছে। এখানে প্রত্যেকটি মানুষই আত্মকাম, নিজের লোভ, ইচ্ছা, আকাঙ্ক্ষা, স্বপ্ন, কল্পনা, বাস্তবতা দ্বারা পরিচালিত।
উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, 'পুতুল নাচের ইতিকথা' উপন্যাসে 'পুতুল' দ্বারা অলৌকিক কোনোকিছু নির্দেশ করে না; বরং বকুল গাছের নিচে পড়ে থাকা পুতুলটিকে দেখে বিজ্ঞানমনস্ক শশী বুঝতে পারে তা সে শ্রীনাথ দোকানির মেয়েকে খেলনা হিসেবে কিনে দিয়েছিল। ঔপন্যাসিক স্পষ্ট করে বুঝিয়েছেন যে, উপন্যাসের পাত্রপাত্রীরা নিজেরাই নিজেদের হাতে গড়া পথে চলতে চলতেই হোঁচট খায়, ব্যর্থ পরিণতিতে পৌঁছায়। সে পরিণতি নিয়তির দ্বারা নয়; বরং তাদের কর্মের দ্বারাই সৃষ্ট পুতুল নামক নিয়তি। মানুষই মানুষের নিয়তি। সুতরাং বলা যায়, 'পুতুল নাচের ইতিকথা' উপন্যাসে ঈশ্বর প্রদত্ত কোনো নিয়তি নয়; বরং তা মানবসৃষ্ট নিয়তি। মানুষের কর্মই তার নিয়তির ক্রীড়নক।