তিতাস একটি নদীর নাম উপন্যাসের গঠন-কৌশল আলোচনা কর। অথবা, তিতাস একটি নদীর নাম উপন্যাসের গঠন-কৌশল বর্ণনা কর
বাংলা সাহিত্যের এক অনন্য সংযোজন অদ্বৈত মল্লবর্মণের তিতাস একটি নদীর নাম উপন্যাসটি। উপন্যাসটি অদ্বৈত মল্লবর্মণকে খ্যাতির শীর্ষে নিয়ে যায়। বাংলা সাহিত্যে নদীকেন্দ্রিক উপন্যাসের মধ্যে নিম্নবর্গের মানুষের আখ্যানসমৃদ্ধ 'তিতাস একটি নদীর নাম' অমর কীর্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। ঔপন্যাসিকের স্বীয় জীবনের অভিজ্ঞতাই এ উপন্যাসের সারাৎসার। এতে তিতাস পাড়ের অন্ত্যজ মালো সম্প্রদায়ের মানুষের দুঃখদুর্দশা, আনন্দ, হাসিকান্না, ক্ষুধা, যন্ত্রণার কথা নিপুণ দক্ষতায় তুলে ধরেছেন ঔপন্যাসিক।
অন্ত্যজ জীবনের আলেখ্য তিতাস একটি নদীর নাম উপন্যাসটিতে রয়েছে ৪টি খণ্ড বা পর্ব। প্রত্যেকটি খন্ড বা পর্বে আবার ২টি করে উপপর্ব রয়েছে। প্রথম পর্বের উপপর্ব দুটি হলো- 'তিতাস একটি নদীর নাম' ও 'প্রবাস খণ্ড'। দ্বিতীয় পর্বের উপপর্ব দুটি হলো- 'নয়া বসত' ও 'জন্ম মৃত্যু বিবাহ'। তৃতীয় পর্বের উপপর্ব দুটির নাম হলো- 'রামধনু' ও 'রাঙা নাও'। আর চতুর্থ খণ্ড বা শেষ পর্বের উপপর্ব দুটি হলো- 'দুরঙা প্রজাপতি' ও 'ভাসমান'। অদ্বৈত মল্লবর্মণ তিতাস তীরের মালো সম্প্রদায়ের সন্তান ছিলেন। গোকনঘাটের তিতাস তীরবর্তী অঞ্চল যেখানে অদ্বৈত জন্মেছিলেন সেই মালোপাড়াই তার উপন্যাসের পটভূমি। উপন্যাসের প্রথম পর্বের প্রথম অংশে অদ্বৈত দার্শনিকদের ভাষায় তিতাস-কথা বর্ণনা করেছেন। এ অংশে অবজ্ঞাত নদী তিতাসের বর্ণনার মোহনীয় ভাষাভঙ্গি গভীর দার্শনিক এক উপলব্ধি সঞ্চার করে পাঠক মনে। সেই সঙ্গে তিতাসকে কেন্দ্র করে মানুষের বাঁচামরার প্রসঙ্গ এবং জীবন-জীবিকার সীমাহীন আখ্যান হয়ে ওঠে তা। উপন্যাসের প্রথম পর্বের দ্বিতীয় অংশে মালোদের জীবনযাত্রার দৃশ্যপট উন্মোচিত হয়। সঙ্গে সঙ্গে মালো জীবনের গভীর সত্য ও বৃহত্তর সংগ্রামী জীবনের ইঙ্গিত এ পর্বকে বিশিষ্ট করে তোলে। কিশোর, বাসন্তী ও সুবলকে ঘিরে করুণ্যময় যে জীবন
তা এখানে' আভাসে প্রকাশিত হয় প্রথমে। মাঘ-মন্ডলের ব্রততে চৌয়ারি ভাসানোর উৎসবকে কেন্দ্র করে জেলেদের সাত বছরের মেয়ে বাসন্তীর প্রতি দুই মালো তরুণের অনুরাগের মধ্য দিয়ে চরিত্র কাঠামো পায়। তিতাসে মাছ না পাওয়ায় এই দুই তরুণ কিশোর ও সুবল দূর প্রবাসে মৎস্য অভিযানে যায়। ওরা উজানিনগরের শুকদেবপুরে খলা বাইতে যায়। সেখানে কিশোর তার প্রেয়সীকে খুঁজে পায়। মোড়লের বউয়ের উদ্যোগে মালাবদল করে গান্ধর্বমতে তাদের বিবাহ হয় এবং ধর্মশাস্ত্রমতে বাড়িতে নিয়ে বিয়ে করার কথা বলা হয়। কিশোরের বাড়িতে ফেরার পথে ডাকাতেরা দু'শত টাকাসহ নববধূকে নিয়ে যায় এবং কিশোর শোকে-দুঃখে উন্মাদ হয়ে যায়। দ্বিতীয় খণ্ডে 'নয়া বসত' অংশে চার বছর পরের ঘটনা বিবৃত হয়েছে। ডাকাতের নৌকা থেকে লাফিয়ে পড়ে সাঁতরে চরে ওঠে কিশোরের বউ। নিত্যানন্দ ও গৌরাঙ্গ নামের দুজন মালো তাকে উদ্ধার করে আশ্রয় দেয়। সেখানে অনন্তর জন্ম হয় এবং চার বছর অতিবাহিত হয়। এতদিন পর কিশোর কর্তৃক না চেনার ভয় তার বুকে। আবার ডাকাত দল যাকে অপহরণ করেছে তাকে সে মেনে নেবে কি না এ সংশয়ও ছিল, ছিল সমাজ সংসারের ভয়ও। গোকর্ণঘাট গ্রামের মালোপাড়ায় এসে অনন্তর মা ঘর তোলে। এরপর 'জন্ম মৃত্যু বিবাহ' পর্বে জানা যায় যে, কিশোরের বন্ধু সুবলের সাথে বাসন্তীর বিয়ে হয় এবং কালোবরণের নৌকায় মাসিক মজুরিতে খ্যাপে গিয়ে নৌ দুর্ঘটনায় সুবল মারা যায়। বাসন্তী হয়ে যায় সুবলের বিধবা বউ। বাসন্তী অনন্তর মাকে সুতা কাটা শেখায়, সবরকম সাহায্য করে। তীব্র দারিদ্র্যের কারণে বাসন্তীর মা-বাবা এতে রুষ্ট হয়। এই পর্বেই ঘটনাচক্রে অনন্তের মা উন্মাদ স্বামীকে চিনতে পারে এবং তাকে সুস্থ করার জন্য সেবাযত্ন শুরু করে। দোল উৎসবের দিন কিশোরকে রাঙিয়ে দিয়ে অনন্তর মা তার পূর্ব স্মৃতি ফিরিয়ে আনতে চায়। কিশোর কিছুটা সুস্থও হয় এবং অধীর হয়ে স্ত্রীকে আদর করতে গেলে অনন্তর মা মূর্ছা যায় এবং হোলিতে উন্মত্ত প্রতিবেশীরা কিশোরকে মারধর করে। কোনোরকমে রাত কাটিয়ে ভোরে কিশোর মারা যায় এবং চারদিন পর মারা যায় অনন্তর মা। কেউ জানলই না যে কিশোর ও অনন্তর মা স্বামী-স্ত্রী ছিল। তৃতীয় খণ্ডের 'রামধনু' অংশে মায়ের মৃত্যুর পর বাসন্তীর বাড়িতে অনন্তর আশ্রয় গ্রহণ, মায়ের শ্রাদ্ধ সম্পন্ন এবং সেখান থেকে বিতাড়িত হওয়ার ঘটনা রয়েছে। আমিনপুরের চাষি কাদির, জেলে বনমালী, বনমালীর ভগ্নী উদয়তারা এবং বাসন্তী এ পর্বের ঘটনাকে এগিয়ে নিয়ে গেছে। অনন্ত উদয়তারা ও তার ভাই বনমালীর কাছে আশ্রয় পায় এবং পুত্রস্নেহে পালিত হতে থাকে। এখানে অনন্তর সাথে অনন্তবালার পরিচয় হয়। 'রাঙা নাও' অংশটিতে নৌকাবাইচের সময় মাসি বাসন্তীর সঙ্গে অনন্তর দেখা হয় এবং উদয়তারার সঙ্গে সংঘর্ষ হয়। চতুর্থ খন্ডের 'দুরঙা প্রজাপতি' অংশে অনন্তর উচ্চশিক্ষার উদ্দেশ্যে শহরে গমন এবং মালোদের নিজস্ব সংস্কৃতির ওপর আঘাত আসে। উপন্যাসের চতুর্থ খন্ডের শেষ পর্বে দেখা যায়, সখী অনন্তবালা অনন্তর জন্য বিবাহের বয়স পার করে দেয় কিন্তু অনন্ত আর ফিরে আসে না। তিতাস নদীতে চর পড়ে জেলেদের জীবন সংকীর্ণ হয়ে পড়ে এবং অনেকে গ্রাম ছেড়ে চলে যায়, অনেকে মারা যায় অনাহারে। এই দুর্দশার সময় অনন্ত আসে মালোদের পাশে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত গোকনঘাট গ্রামের মালোপাড়ার আর কেউ অবশিষ্ট থাকে না, জেলেপল্লি বিরান হয়ে যায়।
উপন্যাস নির্মাণের প্রায় সকল শর্তাবলি 'ততাস একটি নদীর নাম' উপন্যাসে অনুসৃত হয়েছে। উপন্যাসটিতে বিভিন্ন স্থানে নাটকীয় আবহ পরিলক্ষিত হয়। যেমন-
১. কিশোর ও তার স্ত্রীর অনুরাগ প্রকাশ হওয়ার ঘটনায় নাটকীয়তা বিদ্যমান। দলের ভিতর সেই মেয়েটিকেও দেখা গেল। মার পায়ের দিকে তাকাইয়া সেও তালে তালে পা ফেলিতে ছিল। কিশোরের সহিত চোখাচোখি হইয়া সে তাল কাটা পড়িল। পা আর উঠিতে চাহিল না।... মুহূর্তের মধ্যে মুমূর্ষুর হাত হইতে সেই লাঠি ছিনাইয়া লইয়া সে আগাইয়া যাইতেছিল, পিছন হইতে টান পড়ায় ফিরিয়া দেখে তার ধুতির খুট দুই হাতে মুঠা করিয়া ধরিয়া মেয়েটা মূর্ছা যাইতেছে।... ইহারই পটভূমিকায় কিশোর মূর্ছিতা মেয়েটাকে পাঁজা-কোলা করিয়া তুলিয়া ঘন ঘন হাঁকিতে লাগিল, 'এর মাকেই, এর মা কই! ডরে অজ্ঞান হইয়া গেছে! জল আন, পাংখা আন।'
২. কিশোরের নৌকায় ডাকাতির ঘটনাও নাটকীয় আবহে বর্ণিত হয়েছে। ফিস ফিস শব্দ শুনে তিলক কিশোর ও নববধূর প্রেমালাপ ভেবে বিরক্ত হয়ে পাশ ফিরে শুতে নিয়ে অনুভব করে যে তার পা বাঁধা। এরপর তিনজনেই দেখে তাদের পা বাঁধা এবং তারা ছইয়ের বাইরে। ততক্ষণে কিশোরের স্ত্রী এবং টাকা ডাকাতি হয়ে গেছে।
"তিলক চিৎকার করিয়া উঠিল, 'অ-কিশোর, আর কত ঘুমাইবা, চাইয়া দেখ সর্বনাশ হইয়া গেছে। একে ঝটকায় পায়ের বাঁধন ছিড়িয়া কিশোর এক নিঃশ্বাসে ছইয়ের ভিতরে গিয়া পাটাতন খুলিল। সে নাই।”
বস্তুত অদ্বৈত মল্লবর্মণের তিতাসই পেরেছে বদ্বীপ-ভূমির নদ চুম্বিত গঠনশীল-নিত্য জায়মান ও চকিতে ভেঙে যাবার অনিশ্চিত জীবনের ছকটিকে আয়ত্ত করতে। মালোদের জীবনপ্রবাহের মধ্য দিয়েই তৈরি হয়েছে উপন্যাসের অসংখ্য চরিত্র। এগুলোর আগমন প্রস্থানের সময়কালই যেন কাহিনির ভিত্তি হিসেবে গড়ে উঠেছে। মালোদের অনির্দিষ্ট জীবনপ্রবাহ ও অনির্দিষ্ট নদী-প্রবাহ এ উপন্যাসের গঠনশৈলীর ওপরও যেন প্রভাব ফেলছে। এ সম্পর্কে শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন,
"এ উপন্যাসটির গঠন নির্দোষ নহে। উহার ঘটনা বিন্যাস এককেন্দ্রিক নহে, বহুসুর বিভক্ত; উহার প্রধান চরিত্রসমূহ বিভিন্ন পর্যায়ে বিভিন্ন। উহার ঘটনা পরিণতিও নানা বিচ্ছিন্ন, কিন্তু একইভাবে সূত্র গ্রথিত আখ্যানের যোগফল, কোন বিশেষ চরিত্রের অনিবার্য ক্রমবিকাশাভিমুখী নহে।... বদ্ধমূল সংস্কৃতি চর্চায়। কোন ব্যক্তি বিশেষের নয়, এই সমষ্টি জীবনের চিত্রাঙ্কনে তাহার প্রতিভার বৈশিষ্ট্য।
"শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের এ কথারই প্রতিধ্বনি লক্ষ্যযোগ্য অন্য একজন সমালোচকের কথায় "মানুষ ও প্রকৃতির বিশাল পটভূমিতে তিনি আসলে এই উপন্যসে নদী ও মানুষের এক চিরায়ত যুগলবন্দী রচনা করেছেন।"
উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, সমষ্টি জীবনের চিত্রাঙ্কনের সাফল্য দিয়েছে এ উপন্যাসকে শিল্প মর্যাদা একই প্রেক্ষাপটে বিবেচ্য এর কাহিনি, চরিত্র, ভাষা, সংলাপ, পরিবেশ, এমনকি লেখকের জীবনবোধেও। তিতাস একটি নদীর নাম, উপন্যাসের কাহিনি ও চরিত্রের গঠনক্রিয়া অগ্রসর হয়েছে ছোট ছোট ঢেউয়ে আবর্তিত হয়ে কিছুদূর পর পর বাঁক নেওয়া নদীর মতো। প্রায়ই একটি নতুন মোড়, একটি নতুন ঘটনা, একটি নতুন চরিত্র, একটি নতুন পরিবেশ। তবে সবকিছুরই উৎস এক। বিশাল বিস্তৃত এই কাহিনি পূর্বেই সুপরিকল্পিত এমনটি বলা কঠিন। কিন্তু গভীরভাবে মনোযোগ দিয়ে উপলব্ধি করা যা শিল্পসৃষ্টির আগ্রহের সঙ্গে কাহিনির যেন একটি আত্মিক মিল রয়েছে।