'অর্কেস্ট্রা' কাব্য অবলম্বনে সুধীন্দ্রনাথ দত্তের রোমান্টিকতা কিংবা প্রেমভাবনার পরিচয় তুলে ধর। অথবা, 'অর্কেস্ট্রা' কাব্য অবলম্বনে সুধীন্দ্রনাথ দত্তের নারীভাবনার স্বরূপ ব্যাখ্যা কর।
সুধীন্দ্রনাথ দত্ত (১৯০১) বুদ্ধিদীপ্তি নৈর্ব্যক্তিকতার কবি, সংকতে, চিত্রকল্প, অবচেতনা, অস্তিত্বের ভার, অবক্ষয়, নিঃসঙ্গতার বেদনা, নগরজীবনের ধূসর প্রবাহ এসবই তার কবিতার গুণগত বিশিষ্টতা। মালার্মে ও এলিয়ট দুজনেই তার আদর্শ। অর্কেস্ট্রা একটি দীর্ঘ প্রেমের কবিতা। নির্যাতিত আর্তের অস্তিত্বের শূন্যতাবোধেরও একটি ভালো দলিল। শ্রেষ্ঠ একশোটি বাংলা প্রেমের কবিতার সংকলন হলে শাশ্বতীকে সেখানে রাখা যেতে পারে।
প্রেমের অপসরণ খেদ ও বেদনা, স্মৃতিবিলাস ও রতিবিলাপ সবই এখানে প্রেমের কবিতাকে, মিলনের মনস্তত্ত্বকে নেতির দিক থেকে নির্মাণ করেছে। রোমান্টিক ঐতিহ্যের বহু ধ্বংসাবশেষ বা অবলেশ এ কবিতায় বিকীর্ণ, আঙ্গিক ও চেতনায় এ কবিতা আধুনিক, কাব্যপিপাসুর মনে এর ভাষা শ্রীময় মসৃণ নির্ভার পঙ্ক্তিসমূহের অনুরণন চিরদিনের জন্য মুদ্রিত হয়ে যায়। যেমন,
"স্বপ্নালু নিশা নীল তার আঁখি-সম;
সে রোম রাজির কোমলতা ঘাসে ঘাসে;
পুনরাবৃত্ত রসনায় প্রিয়তম;
কিন্তু সে আজ আর কারে ভালোবাসে।" (শাশ্বতী)
এই প্রেমভাবনার মধ্যে রোমান্টিক স্বপ্নচারিতা এবং আদর্শময় দৃষ্টি নিয়ে অমরার অমৃত সন্ধানের প্রয়াস সুস্পষ্ট। এই প্রেম যৌবনগত কবিচিত্তের আর্তি। এখানে আছে যেমন অতীত মিলনের রসোল্লাস, তেমনি ভবিষ্যৎ বিচ্ছেদের আশঙ্কা। তাই কোমল চিত্তের করুণ ব্যাকুলতা, কম্পিত প্রত্যাশা ও সরোদন মিনতিতে পূর্ণ এর অনেক কবিতা। এই কাব্যের কবিতাগুলোর ভাষা স্বচ্ছন্দ ও সাবলীল, ছন্দবন্ধনও নির্দিষ্ট। শব্দ ও বাক্য প্রয়োগে কবি তার অর্কেস্ট্রা কাব্যে এক সুন্দর ও রোমান্টিকতার চিত্র তুলে ধরেছেন।
অর্কেস্ট্রা (১৯৩৫) সুধীন্দ্রনাথের দ্বিতীয় এবং সবচেয়ে বেশি
সংস্কারকৃত কাব্যগ্রন্থ। সুধীন্দ্রনাথ দত্তের কাব্যের প্রধান বৈশিষ্ট্য দুটি : দর্শন ও প্রেম চেতনা। এসব ছাড়াও ঈশ্বর, প্রকৃতি, ঐতিহ্য, মৃত্যু প্রভৃতি তার অর্কেস্ট্রা কাব্যগ্রন্থের বহু কবিতায় প্রধান হয়ে উঠেছে। বুদ্ধদেব বসু সুধীন্দ্রনাথকে রোমান্টিক কবি বলেছেন। তার ভাষায় "সুধীন্দ্রনাথ মর্মে মর্মে রোমান্টিক কবি এবং একজন শ্রেষ্ঠ রোমান্টিক। এর প্রমাণস্বরূপ একটি বিষয় উল্লেখযোগ্য, বিষয়টি হলো তার প্রেমের কবিতায় আবেগের তীব্রতা, বাসনা ও বেদনার অলজ্জিত ও ব্যক্তিগত চিৎকার, যার তুলনা আবহমান বাংলা সাহিত্যে আমরা সহজে পাব না।"
সুধীন্দ্রনাথের ভূয়সী প্রশংসা করে অধ্যাপক ভূদেব চৌধুরী লিখেছেন,
"....স্বীকার করতেই হয়, পত্রিকা হিসেবে সুধীন্দ্রনাথের 'পরিচয়' -এর শ্রেষ্ঠ দান বাংলা সাহিত্যে পুস্তক সমালোচনার এক অতি
উন্নত-" [অভূতপূর্ব মান)
গদ্য ও পদ্যের ব্যবধান দূর করার মানসে তিনি সাধারণ মানুষের মুখের ভাষাকে কাব্যে স্থান দেননি। তিনি সর্বদা অবিকল শব্দ প্রয়োগের পক্ষপাতী। তাই অপ্রচলিত আভিধানিক শব্দের প্রতি তার আকর্ষণ এত বেশি। সুধীন্দ্রনাথ সম্পর্কে আধুনিক কবি ও সমালোচক বুদ্ধদেব বসু বলেছিলেন, "তার বিষয়ে অনেকেই বলে থাকেন যে তিনি বাংলা কবিতায় ধ্রুপদী রীতির প্রবর্তক। এই কথার প্রতিবাদ করে আমি এই মুহূর্তে বলতে চাই যে, সুধীন্দ্রনাথ মর্মে মর্মে রোমান্টিক কবি, এবং একজন শ্রেষ্ঠ রোমান্টিক।" এজন্য সুধীন্দ্রনাথ আধুনিক কবি হলেও সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র। তার স্বাতন্ত্র্য তার চিন্তায়, ভাবনায়, জীবন দর্শনে এবং কবিতায় শব্দ প্রয়োগে তথা বাক্য গঠনে। ১৯২৫ খ্রিস্টাব্দ থেকে সুধীন্দ্রনাথ দত্ত নানা পত্রিকায় লেখা আরম্ভ করেন। নিজের 'পরিচয়' সহ কবিতা ও অন্যান্য পত্রিকায় তিনি লিখতে থাকেন। তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ তন্বী ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত হয়। দ্বিতীয় কাব্য হিসেবে প্রকাশিত হয় অর্কেস্ট্রা (১৯৩৫)। এরপর একে একে প্রকাশিত হয় তার অন্যান্য কবিতা। তার অর্কেস্ট্রা মূলত প্রেমকাব্য, কাব্যের প্রথম কবিতার নাম হৈমন্তী এবং শেষ কবিতার নাম অর্কেস্ট্রা। কবি এবং সাহিত্যিক সুধীন্দ্রনাথ দত্ত আধুনিক বাংলা সাহিত্যের অন্যতম একজন কবি। তার সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, "মননশীল তার মন, তিনি মনন বিলাসী।" বাংলা ভাষার একজন প্রধান আধুনিক কবি। তাকে কেউ কেউ বাংলা কবিতার ধ্রুপদী রীতির প্রবর্তক বলে থাকেন। আমাদের এই আলোচনায় আধুনিক কবি সুধীন্দ্রনাথ দত্ত সম্পর্কে নানা তথ্য পরিবেশিত হয়েছে। অর্কেস্ট্রা কাব্যগ্রন্থের সূচনাই করেছেন কবির রোমান্টিকতার চিত্ত হাহাকার হৃদয়ে,
"আমার সংকীর্ণ আত্মা, লঙ্ঘ আজ দর্শনের সীমা,
ছুটেছে দক্ষিণাপথে যাযাবর বিহঙ্গের মতো।" (হৈমন্তী)
কবিতার প্রেমের শাশ্বত ও বিরহবোধ ও অতৃপ্তিজনিত অস্থিরতায় কাতর। কবি জানতেন প্রেম শাশ্বত নয় তাই তিনি ক্ষণিক প্রেমের কথা কবিতায় ব্যক্ত করেছেন। কিন্তু তারপর কবির মধ্যে লক্ষ করা যায় অতৃত্তিজনিত অস্থিরতা, বিরহবোধ আর না পাওয়া প্রেমের শাশ্বতবোধ-
"স্মৃতিপিপীলিকা তাই পুঞ্জিত করে
আমার রন্দ্রে মৃত মাধুরীর কণা;
সে ভুলে ভুলুক, কোটি মন্বন্তরে
আমি ভুলিব না, আমি কভু ভুলিব না” (
আমি ভুলিব শাশ্বতী)
রোমান্টিক কবিদের মতো সুধীন্দ্রনাথ দত্তও নারী সৌন্দর্যের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলেন যার প্রমাণ বিভিন্ন কবিতায় উপস্থাপিত। যেমন,
"কুন্ডলে তব শরৎসাঁঝের ঋচ্ছি;
পাকা দ্রাক্ষার মন্দির কান্তি অঙ্গে;
উরসে তোমার মর সাধনার সিম্মি,
ধরা রূপবতী;
যে তোমারই অনুষঙ্গে।” (অর্কেস্ট্রা)
যদি ও কবির অধরে জীবনের জয় ভাষা প্রার্থনা করেছে, কিন্তু সে প্রার্থনা মঞ্জুর হবার কোনো ইঙ্গিত কবিতাকে নেই। বরং পরক্ষণেই নিরামশার মেঘে ভরে গেছে কবির হৃদয়। যেমন,
"যারা ছিল একদিন; কথা দিয়ে; চলে গেছে যারা;
যাদের আগমনবার্তা মিছে বলে বুঝেছি নিশ্চয়;
স্বয়ম্ভু সংগীতে আজ তাদের চপল পরিচয়
আকস্মিক দুরাশায় থেকে করিবে ঈশারা।" (হৈমন্তী)
অনুভবে ও অনুরাগে সিক্ত হয়ে কবি যখন একটি প্রেমঘন আবেশ কল্পনা প্রকৃতি সান্নিধ্যে তখনই নায়িকা তাকে অবিরত উপেক্ষায় আহত করে চলে যায়। এর পরই কবির মধ্যে দেখা যায়, রোমান্টিকতার নির্যাস অস্পষ্ট অনুরাগ। ভালোবাসার রোমান্টিকতায় সিক্ত হয়ে কবি বলেছেন,
"মনে না দুরাশা তবু: মনে হয় এও নিঃস্ব জগতে
এতখানি অপচয় ঘটাবে না বিধি কোনও মতে" [অপচয়।
'মহাশ্বেতা' কবিতায় তাপিত হৃদয়ের হাহাকার ব্যাপৃত। অর্কেস্ট্রা কাব্যগ্রন্থের মূলচেতনার ধারক শাশ্বতী কবিতা। মার্সেলের বিখ্যাত উপন্যাসে রয়েছে স্মৃতির প্রগাঢ় আলোড়ন ও রূপমূর্তি রচনা, আর শাশ্বতী কবিতাটিতে রয়েছে অপসৃত প্রেমের চলে যাওয়া পদধ্বনি গোনা-দীর্ঘনিঃশ্বাস ও স্মৃতিভার গেঁথে গেঁথে আকাঙ্ক্ষার এক সুললিত ও বেদনাময় সাঁকো রচনা। পাঠক যখন শাশ্বতী কবিতাটি পড়তে শুরু করে তখনই সে বুঝতে পারে রোমান্টিক কবিতা শেষ যেখানে, সেখান থেকেই এই কবিতাটির যাত্রা শুরু। রোমান্টিকতার আকীর্ণ ফধ্বংসাবশেষের ভিতর থেকে টুকরো টুকরো উদ্দীপনা আহরণ করেই কবি এ কবিতাটির অবয়ব সাজিয়েছেন, যদিও তার অভীষ্ট যাত্রা আধুনিকতার শিল্পতত্ত্বেরই দিকে। কবির ভাষায়,
"শ্রান্ত বরষা, অবেলার অবসরে,
প্রাকাশে মেলে দিয়েছে শ্যামল কায়া;
স্বর্ণ সুযোগে লুকাচুরি খেলা করে
গগনে গগনে পলাতক আলো-ছায়া।
আগত শরৎ অগোচর প্রতিবেশে;
হানে মুদঙ্গ বাতাসে প্রতিধ্বনি;
মূক প্রতীক্ষা সমাপ্ত অবশেষে,
মাঠে, ঘাটে, বাটে আবন্ধ আগমনী।"