"রামমোহন ইয়োরোপীয় জ্ঞানবিজ্ঞানের চমৎকারিত্বের ইঙ্গিত দিয়েছেন মাত্র, কিন্তু সেই জ্ঞানের স্বাদ বাঙালি প্রকৃত প্রস্তাবে পায় ডিরোজিওর কাছ থেকে।"- উক্তিটির আলোকে বাংলার নবজাগরণে ডিরোজিওর অবদান আলোচনা কর

ভূমিকা: ভারতবর্ষে ব্রিটিশ শাসন প্রবর্তনের ফলে অপকারের পাশাপাশি অনেক উপকারও হয়েছে। কলকাতায় ব্যবসা বাণিজ্যের প্রসারের ফলে বিকাশমান পুঁজিবাদের ওপর ভর করে প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবী মহল গড়ে ওঠে। ব্রিটিশ শাসনের ফলে পাশ্চাত্যের শিক্ষা-সংস্কৃতি ও আচার আচরণের সাথে বাংলার মানুষের সংযোগ শুরু হয়। ফলে ক্রমে ক্রমে নতুন চেতনার উন্মেষ ঘটে। এ চেতনার পুরোধা ব্যক্তিত্ব ছিলেন রাজা রামমোহন রায়। আর বাংলার জাগরণে জোয়ার এনে দিয়েছিল হিন্দু কলেজের ক্ষণকালীন শিক্ষক বিদ্যুৎবহ্নি কবি ডিরোজিও। 

ডিরোজিওর পরিচয়

ক্ষণজন্মা এক কবি, শিক্ষক, দার্শনিক ও প্রখর ব্যক্তিত্বের নাম ডিরোজিও। একজন ইংরেজ হিসেবে ইউরোপীয় সভ্যতায় লালিত ও যাপিত জীবনের অধিকারী ডিরোজিওর বাংলায় আগমন ও বাংলার ঐতিহ্য-সংস্কৃতিতে নতুন প্রাণের জাগরণ সৃষ্টি এক বিস্ময়কর ঘটনা।
হেনরি ডিরোজিও
মাত্র বিশ বছর বয়সে তিনি হিন্দু কলেজে চতুর্থ শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। মাত্র তিন বছর শিক্ষকতা করার পর তিনি বিতাড়িত হন। অল্প বয়সে প্রভূত জ্ঞান অর্জন করে তিনি চিন্তাশীল দার্শনিক ও বাগ্মী হিসেবে খ্যাতি লাভ করেন। 

ডিরোজিওর ভাবনা

গভীর জ্ঞান ও অধ্যয়নের মাধ্যমে ডিরোজিও ইউরোপীয় সভ্যতা সম্পর্কে জেনেছিলেন। তার অন্তরে প্রজ্বলিত ছিল ফরাসি বিপ্লবের মূলমন্ত্র- সাম্য, ভ্রাতৃত্ব ও স্বাধীনতা। জাতিধর্মবর্ণের সংকীর্ণতা ভেঙে উদার ও মুক্ত মন নিয়ে ডিরোজিও তার চিন্তাচেতনা ছাত্রদের অন্তরে সঞ্চারিত করেন। - ডিরোজিওর কাছ থেকে চরিত্রবিদ্যা, সত্যানুরাগ আত্মস্থ করে - তার শিষ্যরা যুক্তি, বিজ্ঞান-ভাবনা ও মানবাধিকারের দীপ্ত বাণী প্রচার করেছিলেন। এসবের মাধ্যমে গোঁড়া ও কুসংস্কারাচ্ছন্ন - হিন্দু প্রচণ্ড ঝাঁকুনি খেয়ে নবজাগরণের পক্ষে প্রভাবিত হয়েছিল। 

ডিরোজিওর প্রভাব

রাজা রামমোহন রায় ভারতবাসীর সম্মুখে যে নবচিন্তার দ্বার উন্মুক্ত করে দিয়েছিলেন তার আলোকচ্ছটা স্বল্প সময়ের মধ্যেই হিন্দু কলেজে গিয়ে পড়ে। মুক্তবুদ্ধি চর্চায় হিন্দু কলেজ গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। আর এর নেতৃত্ব দেন হিন্দু কলেজের চতুর্থ শিক্ষক বিশ বছর বয়সী ডিরোজিও। রামমোহনের দেখানো পথে ফরাসি বিপ্লবের চিন্তার স্বাধীনতা- বহ্নি অন্তরে ধারণ করে ডিরোজিও প্রগতিশীল উদারপন্থি সংস্কারমুক্ত সমমনাদের নিয়ে গড়ে তোলেন 'ইয়ং বেঙ্গল সোসাইটি'। আলোড়ন সৃষ্টিকারী এ সোসাইটি ছিল বিজ্ঞানমনস্ক, যুক্তিবাদী, বস্তুবাদী এবং দৈবে অবিশ্বাসী। হিন্দুসমাজের আচারবিচার, বিধিনিষেধ ইত্যাদির প্রতি ছিল ডিরোজিওর শিষ্যদের অবজ্ঞা। অর্থাৎ ডিরোজিওর শিষ্যরা সমাজের ভিতর একটি নব মনোভাবের প্রবর্তন করতে সক্ষম হয়েছিল। ফলে নিয়োগ লাভের তিন বছরের মাথাতেই ডিরোজিও হিন্দু কলেজ থেকে বহিষ্কৃত হন। কিন্তু তার ভাবশিষ্যদের চিত্তে যে আগুন তিনি জ্বালিয়ে দিয়েছিলেন হিন্দু কলেজ পরিত্যাগের পরও বহুদিন পর্যন্ত সেই তেজ মন্দীভূত হয়নি। 


ডিরোজিওর অবদান

ডিরোজিওর গোষ্ঠীকে তৎকালীন কোনো কোনো সাহিত্যিক রামমোহনের বিরুদ্ধ দল বলে প্রতিপন্ন করার চেষ্টা করেছিলেন। তাদের অভিযোগ ছিল ইয়ং বেঙ্গল সোসাইটি ধর্ম বিষয়ে উদাসীন তো ছিলই, অনেক সময় তারা নাস্তিক ভাবাপন্ন ছিল। আর "If we hate anything from the bottom of our heart it is Hinduism." একথা সোসাইটির কোনো কোনো সদস্য প্রকাশ্যেই ঘোষণা করতেন। পরবর্তীতে এই ডিরোজিওর দল হয়তো রামমোহনের ব্রাহ্মসমাজের নেতাকর্মীও হয়েছিলেন। ডিরোজিও বাঙালির মননে অভিনব স্বাদের যে চমৎকারিত্ব এনে দিয়েছিলেন- সেই পথ ধরেই পরবর্তীতে বাঙালির চিরগর্ব মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের কাব্যসাধনার নতুন পথ অবারিত হয়েছিল। তাছাড়া উনবিংশ শতাব্দীর প্রথমভাগে সাধারণ বিদ্যানুরাগীরা ডিরোজিওর প্রদর্শিত পথে জ্ঞানবিজ্ঞানের যে পাণ্ডিত্য অর্জন করেছিল তা বাস্তবিকই প্রশংসনীয় ছিল। আজও বাঙালি হিন্দুর বিদ্যানুরাগ কমেনি, কিন্তু ডিরোজিওর শিষ্য-প্রশিষ্যদের সেই আন্তরিকতার লালিমা আর আগের মতো নেই। 

উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, ডিরোজিওর দর্শনের সে ভাব স্পন্দন কালের বিবর্তনে আজ কিছুটা ক্ষীয়মাণ হয়ে যাচ্ছে। এখনকার আধুনিক পণ্ডিতরা ডিরোজিওর শিষ্য- প্রশিষ্যদের চেয়ে উন্নততর সেটি প্রাবন্ধিক কাজী আবদুল ওদুদ মানতে নারাজ। এতৎসত্ত্বেও ব্যক্তিত্ব ও সুরুচি সমন্বিত প্রাণবান, অপেক্ষাকৃত সরলচিত্ত ডিরোজিওর দল আমাদের কাছে বিস্মৃতপ্রায়। প্রাবন্ধিক আশাবাদী আজকের এ জাতি সম্প্রদায় বিখণ্ডিত, এ শাস্ত্র উপশাস্ত্র-বার-ক্লিষ্ট, এ পূর্ণাবতার খন্ডাবতার নিপীড়িত বাঙালি জীবন একদিন হয়তো ডিরোজিওকে আবার স্মরণ করবে। ডিরোজিওর সেই আলোড়নই বাঙালি সমাজকে এখনো প্রগতির পথ দেখিয়ে চলছে আলোকবর্তিকার মতো।
আপনারঅদৃশ্যমন্তব্য
Cancel