ঘোড়সওয়ার কবিতার বিষয়বস্তু ও শিল্পসৌন্দর্য বিশ্লেষণ কর
বিষ্ণু দে (১৯০৯-১৯৮২) একাধারে কবি, প্রাবন্ধিক, চিত্রসমালোচক ও শিল্পানুরাগী ছিলেন। ১৯২৩ সালে কল্লোল পত্রিকার মাধ্যমে যে সাহিত্য আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল কবি বিষ্ণু দে তার মধ্যে ছিল অন্যতম। তিনি মার্কসবাদী কবি। তিনি একজন আধুনিক অস্তিত্ববাদী কবি। কাব্যভাবনা ও প্রকাশরীতিতে বুদ্ধিবৃত্তি ও মননশীলতাকে অঙ্গীকার করেই তিনি কবিতা লেখেন। চোরাবালি কাব্যের অন্যতম কবিতা ঘোড়সওয়ার। কবিতায় বহু স্তরের ব্যঞ্জনা থাকায় এর রসাবেসন অধিকতর আকর্ষণধর্মী হয়ে উঠেছে।
একই কবিতায় বহুতর দৃষ্টিভঙ্গির সন্ধান মেলায় কবিতাটি হয়ে উঠেছে এক অন্যান্য রচনা। আবু সায়ীদ আইয়ুব বলেছেন- এটি একটি প্রেমের কবিতা, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত এর মধ্যে খুঁজে পেয়েছেন প্রকৃতি ও পুরুষ, তথা ভক্ত ভগবানের সম্বন্ধ। আধুনিক কাব্য কবিতার বিশিষ্ট সমালোচক দীপ্তি ত্রিপাঠী বলেছেন- কবিতাটির একমুখী ব্যাখ্যা করলে তার প্রতি অবিচার করা হবে। ব্যক্তির অধীর আবেগ ও সমষ্টির প্রবল শক্তি, প্রেম ও সমাজতত্ত্ব কবিতাটির মধ্যে একাকার হয়ে গেছে। উৎসাহ ও উদ্দীপনা এবং গভীর এমন সমন্বয় বাংলা সাহিত্যে দুর্লভ। আসলে কবিতাটিতে মূলত বাঙালি মধ্যবিত্তের বৃহত্তর জনসমষ্টি থেকে বিচ্ছিন্নতার অনুভূতি এবং তা থেকে উদ্ভূত সংকটের চেতনা বাণীরূপ লাভ করেছে। এহেন সংকটের হাত থেকে মুক্তির উপায় হিসেবে কবি মার্কস নির্দেশিত শ্রেণিসংগ্রামের পথকেই গ্রহণ করেছেন। কবিতার শুরুতেই উত্থাপন করেছেন-
"জনসমুদ্রে নেমেছে জোয়ার
হৃদয়ে আমার চড়া।
চোরাবালি আমি দূরদিগন্তে ডাকি-
কোথায় ঘোড়সওয়ার?"
জনতার মাঝে জাগরণের জোয়ার এসেছে। কিন্তু মধ্যবিত্ত বাঙালি সমাজের প্রকৃত স্বরূপ, কবির হৃদয় চড়াভূমির বালুকার রুক্ষতায় ভরা। সেখানে নবতর সৃষ্টির কোনো সম্ভাবনা নেই। আবার সেই হৃদয় চড়ার মাঝে রয়েছে অনেক সীমাবদ্ধতা। অনেক ভ্রান্তির ইতিহাস চোরাবালির মতোই তা প্রতারণার ফাঁদ পেতে রয়েছে। এ থেকে মুক্তি দিতে পারে যে জননেতা, কবির চোখে সে বলদৃপ্ত ঘোড়সওয়ারের রূপ নিয়ে প্রতিভাত। কবি আকুল আবেদনে তাকে আহ্বান জানিয়েছেন। তাইতো কবিকণ্ঠে-
'কেন ভয়? কেন বীরের ভরসা ভোলো?'
এখানে ঘোড়সওয়ারকে জননেতা না ভেবে প্রেমিক পুরুষও ভাবা যায়। প্রেমিকার হৃদয় চড়ার মতো নিঃসঙ্গ নিষ্ফলতায় ভরা। সেখানে আবার বহু প্রকাশ আশঙ্কা, হতাশাবোধ বিষাদের চোরাবালিও সৃষ্টি হয়েছে। বিষ্ণু দে শিল্পীর নিপুণ কারিগর করে প্রেমিক ঘোড়সওয়ারকে যেন প্রেমিকা হৃদয়ের এই শূন্যতাকে দূরে সরিয়ে তার নিষ্ফল হৃদয়কে পরিপূর্ণ করে তোলে। পরবর্তী অংশে এই প্রেম অনুষঙ্গ আরও বেশি স্পষ্ট হয়েছে-
'হে প্রিয় আমার, প্রিয়তমা মোর!
আয়োজন কাঁপে কামনার ঘোর,
অঙ্গে আমার দেবে না অঙ্গীকার?'
মূলত কবির মধ্যে অনুরণিত হয়েছে বিংশ শতকের এক জটিল মানসিকতায় প্রভাব, যুগগত হতাশা ও ক্লান্তিবোধ তার চেতনাকেও আলোড়িত করেছে। প্রাত্যহিক জীবনের অন্তঃসারশূন্যতা, সেই সঙ্গে ব্যক্তিমানবের প্রেমের ক্ষেত্রেও অপরিসীম শূন্যতা। এ দুয়ের সংমিশ্রণে কবিচিত্তের যে বিক্ষোভ তারই জটিল প্রকাশ ঘটেছে কবিতাটিতে। আবার প্রেমের শিল্পকর্মের ক্ষেত্রে আর একটি ভিন্নতর মাত্রাও সংযোজিত হয়েছে। এখানে ঘোড়সওয়ারকে আদিম উর্বরতা বিধায়ক শক্তি হিসেবে কিংবা আদিম প্রজনন পূজার প্রতীক হিসেবেও
একসঙ্গে গ্রহণ করা চলে-
"হালকা হাওয়ায় বল্লম উঁচু ধরো।
সাত সমুদ্র চৌদ্দনদীর পার-
হালকা হাওয়ায় হৃদয় দু-হাতে ভরো।
হঠকারিতায় ভেঙ্গে দাও ভীরু দ্বার।"
ইয়ুং-এর মনস্তাত্ত্বিক ভাবনায় লিবিডোর যে ব্যাপকতর তাৎপর্য উদ্ভাসিত হয়েছিল, তারই চকিত প্রকাশ এ কবিতায় স্পষ্ট হয়-
'পায়ে পায়ে চলে তোমার শরীর ঘেঁষে
আমার কামনা প্রেতচ্ছায়ার বেশে।
চেয়ে দেখ ঐ পিতৃলোকের দ্বারা।'
কবিতার কোনো কোনো অংশে সমষ্টি জীবনের সার্থকতার আশা।
প্রেমের অধীর ব্যাকুলতার সঙ্গে রূপকথার অনুষঙ্গও মিশ্রিত হয়েছে-
"আমার কামনা ছায়ামূর্তির বেশে
পায়ে পায়ে চলে তোমার শরীর ঘেঁষে
কাঁপে তনু-তনুবায়ু কামনায় থরোথরো।"
এই অংশে কামনাতত্ত্বে প্রেমের তীব্রতাই প্রাধান্য পেয়েছে। আবার মধ্যবিত্তের নির্জন মানসিকতার কথাকে উপেক্ষা করা চলে না। মিলন কামনার টানে কিংবা মধ্যবিত্তের সীমাবদ্ধতা ছাড়িয়ে দ্বিধা সংসারের গরিমা কাটিয়ে যে দীপ্ত প্রত্যয়ের প্রকাশ ঘটেছে এখানে তারই প্রতীক হিমবাহ। কিন্তু যে মুক্তিদাতা ঘোড়সওয়ারের উদ্দেশ্যে ব্যাকুল আহ্বান পাঠিয়েছিল চোরাবালি স্বরূপ মধ্যবিত্ত
সে তো দূর দেশের অধিবাসী।
হে দূর দেশের বিশ্ববিজয়ী দীপ্ত ঘোড়সওয়ার!
মুক্তিদাতা প্রেমিকের ছবিও এখানে দূর দেশের সঙ্গে অন্বিত হওয়ায় সুদূরতার মায়ায় যেন একটু মোহময় হয়ে ওঠে। রূপকথার স্বপ্নময় জগতের আবহ যেন এখানে সঞ্চারিত হয়। ঘোড়সওয়ারের চিত্র এসে মিশে যায় বন্দিনী রাজকন্যার দুঃসাহসিক মুক্তি প্রয়াসে উঘ্যত পক্ষিরাজ ঘোড়সওয়ার দূর দেশের রাজকুমারের ভাবচ্ছবি। এইভাবে বিশ শতকের সমস্যাবিজড়িত জীব কবি শিল্পসম্মতভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। সুধীন্দ্রনাথ কথিত প্রকৃতি পুরুষের সম্বন্ধজ্ঞাপক হিসেবেও ঘোড়সওয়ারকে গ্রহণ করার বিপত্তির কিছু নেই। ঘোড়সওয়ারকে ভগবানের প্রতীকরূপে এবং বক্তাকে ভক্তরূপে বিবেচনা করলে কবিতাটির অর্থ গ্রহণে কোনো অসুবিধা হবে না। ভগবানকে প্রিয়তমরূপে দেখা এদেশে নতুন কোনো রীতি নয়। বৈষ্ণব পদাবলির উজ্জ্বল ঐতিহ্যের উত্তর পুরুষ আমরা। সেক্ষেত্রে ভক্ত যদি আকুল আবেদনে ভগবানকে প্রিয়তম সম্ভাষণে আখ্যায়িত করেন তাতে অসুবিধে নেই। এইভাবে এ কবিতাটিতে কবির মানস জটিলতার বিভিন্ন অনুষঙ্গগুলির একাধারে রূপায়িত হয়েছে বলেই কবিতার আঙ্গিকে পরস্পর বিচ্ছিন্ন বা বিষম উপাদানগুলোর সন্নিবেশ ঘটেছে। বস্তু সত্যের বিচারে বাহ্য অসংগতি দেখা দিলেও কাব্য সত্যের সামগ্রিক তাৎপর্যের পরিপ্রেক্ষিতে এই আপাত অসংগতি বৃহত্তর সংগতিসূত্রে মিশে যায়।
উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, চোরাবালি, চড়া, মৃগতৃষ্ণিকা, পাহাড় প্লেসিআর, মেরুচূড়া- সমস্ত কিছুকে কবি একই কবিতার আধারে উপস্থিত করেছেন। বাস্তবে এদের একত্র মেলা ভার কিন্তু বাঙালি মধ্যবিত্ত জীবনের বিচ্ছিন্নতা, প্রেমের নিষ্ফলতা ইত্যাদি থেকে উত্তরণের উপায় হিসেবে এই বিষয়বস্তুগুলো সম্ভাব্য সংগতির তাৎপর্যে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। এদিক থেকে কবিতাটির শিল্পসাফল্য অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ।