“জলসাঘর” গল্পে ক্ষয়িষ্ণু জমিদারতন্ত্রের যে চিত্র ফুটে উঠেছে তা তুলে ধর
রবীন্দ্র-পরবর্তী বাংলা সাহিত্যের অন্যতম কথাসাহিত্যিক তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় ছোটগল্পের বিষয় বৈচিত্র্য ও চরিত্র চিত্রণে অনন্য। তারাশঙ্করের অভিজ্ঞতার রাজ্যে বিভিন্ন চরিত্র ও বিষয়ের প্রাধান্য থাকলেও ক্ষয়িষ্ণু জমিদারদের প্রতি তার ছিল প্রচ্ছন্ন অনুরাগ। তাই তার গল্পে জমিদারদের ম্লান ঐশ্বর্য উঠে আসে। 'জলসাঘর' গল্পে লেখক সুস্পষ্টভাবে তুলে ধরেছেন পতন্যেম্মুখ সামন্ত সমাজকে এবং হয়ে ওঠা পুঁজিবাদী, ধনতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থাকে।
তারাশঙ্কর গল্পের শুরু করেছেন গল্পের নায়ক অন্যমনষ্ক, আত্মমগ্ন নতশির প্রৌঢ় বিশ্বম্ভর রায়ের রাত্রি শেষে ভোর তিনটায় ছাদে নিঃসঙ্গ পায়চারি করার বর্ণনা দিয়ে। এমন ভোরের প্রাকৃতিক পরিবেশে চোখে পড়ে আকাশের দক্ষিণ-পূর্ব কোণে উজ্জ্বল শুকতারা। রায়বাড়ি থেকে দূরে উঁচু প্রাসাদে মাথায় জ্বলে উঠতি বড়লোক গাঙুলী বাবুদের অকম্পিত বিজলি বাতি। এসময়ে গাঙুলী বাড়ির পেটা ঘড়িতে তিনটের সংকেত বাজে। গল্পকার প্রথমেই প্রতীকের আশ্রয়ে শুকতারা দিয়ে বিশ্বম্ভর রায়ের ডুবন্ত অবস্থাকে বুঝিয়েছেন। আর গাঙুলী বাড়ির মাথায় বিজলি বাতির জ্বলার দৃশ্য দিয়ে ধনতন্ত্রের জয় ঘোষণা করেছেন। লেখক বিষয়টি আরও স্পষ্ট করেছেন ঘড়ির ঘণ্টা ধ্বনি বাজানোর মাধ্যমে-"ঢং-ঢং-ঢং করিয়া গাঙুলীবাবুদের ছাদে তিনটার ঘড়ি এতক্ষণে পেটা হইল। পূর্বে দুইশত বৎসর ধরিয়া এ অঞ্চলে ঘড়ি বাজিত রায়বাবুদের বাড়িতে, এখন আর বাজে না।"
রায় বংশের প্রথম চার পুরুষের মাঝে যে ভোগলিপ্সা, শৌর্য, দন্ত ছিল শেষের তিন পুরুষে তা ক্রমেই শূন্যতায় রূপ নিয়েছে। রায় বংশের সপ্তম পুরুষ বিশ্বম্ভর রায়ের সামনে কেবল অন্ধকার ভবিষ্যৎ। কারণ, "তিন পুরুষ ধরিয়া রায়েরা করিয়াছিলেন সঞ্চয়। চতুর্থ পুরুষ করিয়াছিলেন রাজত্ব। পঞ্চম ও ষষ্ঠ পুরুষ করিলেন ভোগ ও ঋণ। সপ্তম পুরুষ বিশ্বস্তরের আমলেই রায়বাড়ির লক্ষ্মী সে ঋণসমুদ্রে তলাইয়া গেলেন।"
পুরানো জমিদারতন্ত্রের পাশাপাশি নব্য বণিক সভ্যতা থেকে উদ্ভূত নতুন ধনী মহিম গাঙুলী চরিত্র 'জলসাঘর' গল্পের বিশ্বম্ভর রায়ের তথা সামন্ত শ্রেণির পতনের চিত্রাঙ্কনে সহায়ক টাইপ। সে নতুন সভ্যতার সব উপকরণ ও সামাজিকতা নিয়ে গল্পে উপস্থিত। বুর্জোয়া সভ্যতার এ প্রতিনিধির মধ্যে রয়েছে প্রতিদ্বন্দ্বিতার মনোভাব এবং পুরোনো জমিদারতন্ত্রের প্রতি উপেক্ষা, উপহাস আর ব্যঙ্গ। সামন্ত জমিদার বিশ্বস্তরের বাড়িতে মহিম গাঙুলীর উপস্থিতি লেখক বর্ণনা করেছেন এভাবে- "অপরাহে গাঙুলীদের ঝকঝকে মোটরখানা আসিয়া লাগিল রায়বাড়ির ভাঙা দেউরিতে।" এই ঝকঝকে গাড়ি ফুলে ফেঁপে ওঠা পুঁজিবাদের প্রতীক। আর বিশ্বম্ভর রায়ের ভাঙা দেউরি ম্রিয়মাণ সামন্তবাদের প্রতীক।
সামন্তবাদের পতনের মূল কারণ হিসেবে লেখক যে বিষয়টিকে চিহ্নিত করেছেন তা হলো সামন্ত সমাজ প্রভুদের লাগামহীন ভোগবিলাসিতা। জলসাঘরকে লেখক দেখাতে চেয়েছেন ভোগবিলাসিতার প্রতীক হিসেবে। এই জলসাঘরই রায় বংশের পতনের মূল কারণ। বিশ্বম্ভর রায়ের পূর্বপুরুষ রাবণেশ্বর রায় জলসাঘর তৈরি করেছিলেন। প্রথম যেদিন সে মজলিস করেছিল সেদিনই তার স্ত্রী-পুত্র সব শেষ হয়েছে। পরবর্তী পূর্বপুরুষ তারকেশ্বর বন্ধুর সাথে অসম প্রতিযোগিতায় নেমে ঢেলেছে অঢেল সম্পদ-। লেখকের বর্ণনায়-"তিনি একরাত্রে এই ঘরে এক আমির বন্ধুর সহিত প্রতিযোগিতা করিয়া পাঁচশত মোহর এক বাইজীকে বকশিশ করিয়া গিয়াছেন।"
বিশ্বম্ভর রায়ের রক্তেও প্রবাহিত এ সামন্ততান্ত্রিক রক্তের ধারা। তার যৌবনে চন্দ্রা বাইজির কথা, স্ত্রী-পুত্র মারা যাওয়ার পরও ভোগবিলাসিতায় মেতে থাকা তারই স্বাক্ষর বহন করে। সবকিছু শেষ হয়ে যাওয়ার পরও বৃদ্ধ বয়সে বিশ্বস্তরের রক্তে নতুন করে জেগে ওঠে এই সামন্ততান্ত্রিক প্রবাহ; যৌবনের চন্দ্রাবাইয়ের প্রতিচ্ছবি দেখেন কৃষ্ণাবাইয়ের মধ্যে।
নিজের আত্মসম্মান বজায় রাখা এবং মহিম গাঙুলীর আচরণের জবাব দেওয়ার জন্য এক অসম প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয় বিশ্বশুর রায়। ঋণগ্রস্ত সর্বস্বান্ত বিশ্বম্ভরের ঝাড়লণ্ঠনের ম্লান আলোকে ব্যঙ্গ করে মহিম গাঙুলীর নিজস্ব ডায়নামোর বৈদ্যুতিক আলোকমালা উজ্জ্বলতর হয়ে ওঠে। বাইজিকে বকশিস দিতে গিয়ে বিশ্বস্তরের পারিবারিক গয়নার বাক্স নিঃশেষ হয়ে যায়। প্রয়াত স্ত্রীর স্মৃতিধন্য শেষ অলংকারটির মায়াও তাকে ত্যাগ করতে হয়। কিন্তু তার চোখের সামনেই মহিম টাকার তোড়া নামিয়ে দেয়। এই অসম প্রতিযোগিতাই বিশ্বস্তরের তথা জমিদারতন্ত্রের পতন ডেকে এনেছে। অতীত ঐতিহ্যের মোহ, পুরোনো খ্যাতি ও প্রতিষ্ঠার মোহই বিশ্বস্তরের ধ্বংস ডেকে এনেছে। গল্পকারের কথা- "মোহ! কেবল তাহার নহে, সাত বায়ের মোহ এই ঘরে জমিয়া আছে।” বিশ্বস্তর রায়ের বর্তমান শূন্য হলেও তিনি অতীতের মোহকে আঁকড়ে ধরে থাকতে চেয়েছেন। কিন্তু কেবল অতীতের মোহ জমিদারতন্ত্রকে টিকিয়ে রাখতে পারে না। তাই 'জলসাঘর' গল্পে ক্ষয়িষ্ণু জমিদারতন্ত্রের চিত্রটি শৈল্পিক এবং বিশ্বাসযোগ্য করে তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছেন।
পুঁজিবাদী সভ্যতা ও সামন্ততন্ত্র সমাজের অসম-সংগ্রাম তারাশঙ্করের ক্ষেত্রে কোনো কল্পিত ব্যাপার ছিল না। গ্রামীণ সমাজে নতুন বণিক শ্রেণির উদ্ভব ও তাদের সঙ্গে জমিদার শ্রেণির নিয়মিত সামাজিক বিরোধ তার নিজের চোখেই দেখা। সামন্ততন্ত্রের গৌরবোজ্জ্বল দিনগুলো তিনি চোখে দেখেননি। কিন্তু অনেক জমিদারের দুর্দান্ত প্রতাপের কাহিনি তার শোনা ছিল। আর তিনি নিজেই ছিলেন জমিদার পরিবারের লোক তাই অল্প বিস্তর তার নিজের চোখেও দেখেছেন। মূলত লেখকের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার বলেই 'জলসাঘর' গল্পে ক্ষয়িষ্ণু জমিদার শ্রেণির পতন স্পষ্টতর ও বিশ্বাসযোগ্য হয়ে উঠেছে।