'বাঙ্গালা ভাষা' প্রবন্ধে বাংলা ভাষার আদর্শ রূপ সম্পর্কে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের মতামত বিশ্লেষণ কর

বাঙ্গালা ভাষা প্রবন্ধে বাংলা ভাষার আদর্শ রূপ সম্পর্কে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের মতামত বিশ্লেষণ কর

"রচনার প্রধান গুণ এবং প্রয়োজন সরলতা এবং স্পষ্টতা।"- 'বাঙ্গালা ভাষা' প্রবন্ধ অনুসারে আলোচনা কর

বাংলা সাহিত্যের প্রবাদ পুরুষ বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। বিষয় বৈচিত্র্যে ও বিষয়োপযোগী সরস রচনাভঙ্গির কারণে তার হাতে প্রবন্ধ সাহিত্য অধিক সমৃদ্ধ হয়েছে। বঙ্কিমচন্দ্রের প্রতিভাস্পর্শে বাংলা প্রবন্ধ এক নবতর জীবনীশক্তি অর্জন করে এবং জ্ঞানগর্ভ, তথ্যনিষ্ঠ প্রবন্ধও আবেগাস্নিগ্ধ সাহিত্যিক স্বাদমণ্ডিত হয়। গভীর পাণ্ডিত্য, মননশীলতা ও বিচারবিশ্লেষণী দৃষ্টির সাথে সুগভীর ও সমুন্নত রসবোধের সহজ সমন্বয়সাধনই বঙ্কিম প্রবন্ধের বৈশিষ্ট্য। 'বাঙ্গালা ভাষা' প্রবন্ধটি তার নিপুণ প্রতিভার শিল্পভাষ্য।

'বাঙ্গালা ভাষা' প্রবন্ধে ভাষা সাহিত্য সম্পর্কে বঙ্কিমের অভিমত সবচেয়ে তীব্র ও সুস্পষ্টভাবে প্রকাশ পেয়েছে। এখানে তিনি বাংলা ভাষার গতিপ্রকৃতির পরিচয় প্রদানপূর্বক বাংলা সাহিত্যের রচনাদর্শ কেমন হওয়া উচিত সে সম্পর্কে যুক্তিনিষ্ঠ যুগান্তকারী, সর্বজনগ্রাহ্য মতামত ব্যক্ত করেছেন। বাংলা গদ্যের প্রথম দিকে গদ্যের ধরন নিয়ে প্রাচীনপন্থি ও নব্যপন্থি পন্ডিতদের মধ্যে তর্কবিতর্ক সৃষ্টি হয়েছিল। বঙ্কিমচন্দ্র এ উভয়পক্ষের মতামতের বিশ্লেষণ করে তিনি মধ্যপন্থা অবলম্বন করে উৎকৃস্ট বাংলা রচনার রীতি প্রবর্তন করেন।

বঙ্কিমচন্দ্র প্রাচীনপন্থি ও নব্যপন্ধিদের যুক্তিতর্কের অবসানকল্পে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য সম্পর্কে যুক্তিসংগত দিক নির্দেশনা প্রদান করে 'বাঙ্গালা ভাষা' প্রবন্ধটি রচনা করেন। এতে তিনি বাংলা গদ্য রচনার উৎকৃষ্ট রীতি সম্পর্কে আলোকপাত করেছেন। শ্যামাচরণ বাবু বাংলা শব্দকে তিন শ্রেণিতে বিভক্ত করে বলেন যে, রূপান্তরিত সংস্কৃতমূলক শব্দের পরিবর্তে কোনো স্থানেই অরূপান্তরিত মূল সংস্কৃত শব্দ ব্যবহার করা কর্তব্য নয়। যেমন মাথার পরিবর্তে মস্তক, বামনের পরিবর্তে ব্রাহ্মণ ব্যবহার করা যাবে না। ন্যায়রত্ন মহাশয় যেভাবে আলালী ভাষাকে প্রত্যাখ্যান করেছেন, একইভাবে শ্যামাচরণ বাবুও সংস্কৃত বিমুখ ছিলেন। বঙ্কিম এদুটির কোনো মতকেই গ্রহণ করেননি। তিনি নিরপেক্ষভাবে মধ্যপন্থা অবলম্বন করেছেন। বঙ্কিমের মতে, যেসব সংস্কৃত ভাষা প্রচলিত আছে তা বর্জন করা উচিত নয়। এদের বর্জনে ভাষা কিয়দংশে ধনশূন্য হবে। অকারণে ভাষাকে ধনশূন্য করার পক্ষপাতী বঙ্কিম নন। আবার যেসব শব্দের আদিম রূপ সবার নিকট প্রচলিত বা বোধগম্য নয়, তার অপভ্রংশই প্রচলিত এবং সবার বোধগম্য এমন স্থানে কখনোই আদিম রূপ ব্যবহার করা যাবে না। বঙ্কিমচন্দ্র অকারণে বাংলা ছেড়ে সংস্কৃত শব্দ লেখার পক্ষে ছিলেন না। তার মতে, সংস্কৃত ছেড়ে বাংলা শব্দ ব্যবহার করলে রচনা অধিক মধুর, সুস্পষ্ট ও তেজস্বী হয়। তাছাড়া বঙ্কিম মনে করেন, বাংলা এখনো অসম্পূর্ণ ভাষা, তাই তার অভাব পূরণের জন্য অন্য ভাষা হতে শব্দ গ্রহণ করা যেতে পারে। আর এক্ষেত্রে সংস্কৃত ভাষা বাংলার সাথে ভালো মিশবে। তাই সংস্কৃত থেকেই শব্দ গ্রহণ করা যেতে পারে।

বঙ্কিমের মতে, সাহিত্য বা গ্রন্থ রচিত হয় যে পড়বে তার বুঝার জন্য। সাহিত্যের উদ্দেশ্য পরোপকার, জনসাধারণের জ্ঞান বৃদ্ধি ও চিত্তোন্নতি। তাই যে ভাষ্য সবার বোধগম্য বা অধিকাংশ লোকের বোধগম্য সে ভাষাতেই সাহিত্য প্রণীত হওয়া উচিত। সকলকে জ্ঞানার্জনের সুযোগ করে দিতে হবে সহজ সাবলীল ভাষায়। পাঠক গ্রন্থ পাঠ করে কিছু বুঝতে না পারলে সাহিত্য ও গ্রন্থের উদ্দেশ্য বিফল হবে। কিন্তু নানা বিষয়ের অনুষঙ্গে সাহিত্য বা গ্রন্থ প্রণীত হয়। কোনো বিষয় গম্ভীর, কোনোটির লঘু। তাই বঙ্কিম সিদ্ধান্তগ্রহণ করেছেন যে, বিষয় অনুসারেই রচনার ভাষার উচ্চতা বা সামান্যতা নির্ধারিত হওয়া উচিত। এক্ষেত্রে বঙ্কিমচন্দ্র উদার নীতির সমর্থক। সাহিত্যের মূল উদ্দেশ্য বিষয়বস্তু অনুধাবন বা হৃদয়ঙ্গম করা এবং সৌন্দর্য সৃষ্টি করা। তাই বিষয়ের প্রয়োজনে, বক্তব্যের সরলীকরণে, বোধগম্যতার বা স্পষ্টতার স্বার্থে যেকোনো ধরনের ভাষা ও শব্দ ব্যবহার করা যাবে। বঙ্কিমের মতে, রচনার প্রধান গুণ এবং প্রথম প্রয়োজন সরলতা ও স্পষ্টতা। যে রচনা সবাই বুঝতে সক্ষম, যার অর্থ গৌরব আছে সেটিই সর্বোৎকৃষ্ট রচনা। এরপর ভাষার সরলতা ও স্পষ্টতার সাথে সৌন্দর্য মিশাতে হবে। অনেক রচনার মুখ্য উদ্দেশ্য সৌন্দর্য সৃষ্টি। সেক্ষেত্রে সৌন্দর্যের অনুরোধে বা খাতিরে শব্দে একটু অসাধারণত্ব মেনে নিতেই হবে। যেকোনো রচনায় প্রথমে দেখতে হবে রচনার বক্তব্য বিষয় কোন ভাষায় সর্বাপেক্ষা পরিষ্কাররূপে ব্যক্ত হয়। রচনার যা বক্তব্য তা যে ভাষায় সর্বাপেক্ষা সুস্পষ্ট ও সুন্দর হয় সে ভাষাই গ্রহণ করতে হবে। যদি হুতোমি বা টেকচাঁদী ভাষায় কার্যসিদ্ধি হয়, তবে তাই ব্যবহার করতে হবে। যদি বিদ্যাসাগর বা ভূদেব বাবু প্রদর্শিত সংস্কৃতবহুল ভাষায় ভাব স্পষ্ট ও সুন্দররূপে প্রকাশ পায় তবে সে ভাষাই ব্যবহার করতে হবে। যদি তাতেও কার্যসিদ্ধি না হয় তবে আরও উপরে ওঠা যাবে। সুস্পষ্ট বক্তব্য প্রকাশের প্রয়োজনে কোনোটিতেই আপত্তি নেই, কিন্তু নিষ্প্রয়োজনে আপত্তি। বক্তব্য পরিস্ফুট করার জন্য অশ্লীল ব্যতীত যেকোনো ভাষা ব্যবহার করা যাবে।

বঙ্কিম শুধু সফল ঔপন্যাসিক বা প্রাবন্ধিকই নন, তিনি একজন ভাষাশিল্পীও বটে। সংস্কৃত অনুসারী প্রাচীনপন্থি পন্ডিত ও আলালী ভাষা অনুসারী নব্যপন্থি উভয়ের মতামতে পক্ষপাতিত্ব। থাকায় বঙ্কিমচন্দ্র কোনোটিই গ্রহণ করেননি। তিনি বাংলা ভাষার সমৃদ্ধি, সৌন্দর্য ও উন্নয়ন চেয়েছেন। একারণে তিনি ভাষায় শব্দ ব্যবহারে সমন্বয় চেয়েছেন। প্রচলিত শব্দকে বর্জন করতে চাননি, প্রয়োজনে অপ্রচলিত শব্দ ও গ্রহণ করতে বলেছেন, কিন্তু তা অকারণে নয়। যথাযথ। শব্দ বাংলায় না থাকলে তবেই অপ্রচলিত সংস্কৃত বা বিদেশি শব্দ নেওয়া যাবে। মোটকথা শব্দশৈলী গঠনে সচেতন হবে যেন তা সকলের বোধগম্য, মনঃপূত হয়। 

উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, বিশিষ্ট মনীষার অধিকারী বঙ্কিম 'বাঙ্গালা ভাষা' প্রবন্ধে এক যুগান্তকারী, সর্বজনগ্রাহ্য, সর্বজনীন উৎকৃষ্ট ভাষারীতির কথা বলেছেন। তার ভাষাচিন্তার বৈশিষ্ট হলো- সারল্য, বোধগম্যতা বা স্পষ্টতা ও সৌন্দর্যময়তা বা শ্রুতিমাধুর্যতা। তিনি সংস্কৃত সেবা সাধুরীতি কিংবা লঘু আলালী রীতি কোনোটারই একাধিপত্য মেনে নেননি। তার মতে, বিষয় অনুসারে, বক্তব্য স্পষ্টভাবে প্রকাশে, ভাষার সৌন্দর্য সৃষ্টিতে যেমন ভাষা প্রয়োজন তেমনই ব্যবহার করতে হবে, অর্থাৎ বিষয়বস্তু অনুসারে ভাষা উচ্চ কিংবা সামান্য লঘু কিংবা গাম্ভীর্যপূর্ণ হবে।
আপনারঅদৃশ্যমন্তব্য
Cancel