রবীন্দ্রনাথের 'সাহিত্য' প্রবন্ধ অনুসরণে সাহিত্যের স্বরূপ বিশ্লেষণ কর।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কবি হিসেবেই সমাধিক পরিচিত লাভ করলেও সাহিত্যের এমন কোনো শাখা নেই যেখানে তিনি প্রবেশ করেননি। তার ক্ষুরধার লেখনীতে ঋদ্ধ হয়েছে বাংলা সাহিত্যের প্রতিটি শাখা। তিনি কবিতা, উপন্যাস, ছোটগল্প, প্রবন্ধ, নাটক, প্রহসন, সংগীত সবই রচনা করেছেন। তার প্রাবন্ধিক পরিচয় কবি পরিচয়ের তুলনায় ম্লান হলেও তিনি তার প্রবন্ধগুলোকে ঋদ্ধ করেছেন তার চিন্তার প্রকাশভঙ্গিতে। তার ক্ষুরধার লেখনীতে তার দর্শন প্রকাশমান।
রবীন্দ্রনাথ তার প্রবন্ধে রাষ্ট্র, সমাজ, ধর্ম, ইতিহাস, অর্থনীতি, শিক্ষা, হিন্দু-মুসলিম সংঘাত, সাহিত্য, কবি সাহিত্যিক ইত্যকার সকল বিষয় নিয়ে লিখেছেন। সাহিত্য বিষয়ে রবীন্দ্রনাথ একাধিক প্রবন্ধ রচনা করেছেন। এগুলোর মধ্যে 'সাহিত্য' প্রবন্ধটি অন্যতম স্থান দখল করে আছে। সাহিত্য বিষয় ভাবনার ফসল হিসেবে রবীন্দ্রনাথের 'সাহিত্যের পথে' নামক একটি প্রবন্ধগ্রন্থ রয়েছে। 'সাহিত্য' প্রবন্ধটি ১৩৩০ বঙ্গাব্দে রচিত হয়ে এ গ্রন্থে স্থান পায়। এ প্রবন্ধে প্রাবন্ধিক রবীন্দ্রনাথ সাহিত্যের স্বরূপ তুলে ধরেন।
উপনিষদ ব্রহ্মস্বরূপের তিনটি ভাগ আছে সত্যম, জ্ঞানম এবং অনন্তম্। এ তিনটি স্বরূপের মতো মানব আত্মারও তিনটি রূপ আছে। সেগুলো হলো- আমরা আছি, আমরা জানি এবং আমি ব্যক্ত করি। মানুষের এ তিন দিকই অখন্ড সত্য। সত্যের এ তিনটি দিকই মানুষকে নানা কাজে উদ্বুদ্ধ করে।
আমি আছি- সত্যের এ ভাবটি মানুষের নানা কাজে উদ্বুদ্ধ করে। আমি জানি- এরও তাগিদ কম নয়। মানুষের জানার প্রয়োজন অতি বিপুল, তা কেবল বেড়েই চলেছে। আর মানুষের কাছে এর মূল্য অনেক। আমি প্রকাশ করি-এটি ব্রহ্মের অনন্ত স্বরূপের অন্তর্গত। আমি আছি, আমাকে টিকে থাকতে হবে- এ কথাটি সংকীর্ণ। অন্যের টিকে থাকার মধ্যে আমার টিকে থাকা এ ভাবের মধ্যে অনন্তের পরিচয় পাওয়া যায়। এতে আমি আছি এবং অন্যে আছে এ পার্থক্য ঘুচে যায়। এতে অন্যের সাথে ঐক্যের দ্বারা আত্মার ঐশ্বর্য সাধিত হয়। মানুষ একা যেখানে সেখানে, তার প্রকাশ নেই। অন্য মানুষের সাথে যুক্ত হলে বা জীবনকে মহাজীবনের সাথে মিলিত করতে পারলে আনন্দ আবেগ সৃষ্টি হয়। আর এ মহাজীবনের আবেগকে সে নানা সাহিত্যে, স্থাপত্যে, মূর্তিতে, চিত্রে, গানে প্রকাশ করে। সাহিত্য এখানে অন্যতম মাধ্যম।
নিজে নিজে টিকে থাকার জন্য জ্ঞানের প্রয়োজন। কিন্তু সে জ্ঞানে দীপ্তি নেই। পশুদের মতো মানুষের টিকে থাকার প্রবল ইচ্ছা। পশুদের প্রয়োজনীয় জ্ঞান আহরণেও তারা সচেষ্ট। কিন্তু মানুষের আর একটি গুণ আছে যা পশুদের নেই। তা হচ্ছে প্রকাশতত্ত্ব। এটাই মানুষকে শুধু টিকে থাকার সীমার বাইরে নিয়ে সুন্দরভাবে বাঁচতে শেখায়। নিজেকে পরিপূর্ণ করে বহির্জগতে তার দীপ্তি মেলে ধরাই প্রকাশ। আর মানুষ এ প্রকাশ করে নানা রচনায়, সাহিত্যে ও আর্টে।
সাহিত্য হচ্ছে প্রয়োজনীয় জ্ঞানের বাইরেও আহরিত বাড়তি জ্ঞানের বহিঃপ্রকাশ। বাড়তি জ্ঞান না থাকলে তা প্রকাশ করার সুযোগ নেই। যেমন লোহা গরম করতে থাকলে যতক্ষণ না দীপ্ত তাপ পর্যন্ত যায় ততক্ষণ তার প্রকাশ হয় না। বাড়তি তাপ পেলেই তা লাল হয়ে ওঠে। লোহার দীপ্ত তাপের ফলে এটি যেমন তার তাপ প্রকাশ করে স্বকীয়ভাবেই মানুষও তেমনিভাবে তার জ্ঞানের প্রকাশ ঘটায়। সে তার অস্তিত্ব রক্ষার জ্ঞান আহ্বানের পর যে জ্ঞানার্জন করে তা তার দীপ্তি বাড়িয়ে তোলে। সে তখন তার মহান দীপ্তি বাইরে ছড়িয়ে দেয়। এ ছড়িয়ে দেওয়ার অন্যতম মাধ্যম সাহিত্য।
প্রকৃতি সৌন্দর্যকেই আলিঙ্গন করে। তাই রক্তপঙ্কিল অশুচি স্পর্শকে প্রকৃতি তার অমৃত ধারায় মুছে দিচ্ছে। ফুলগুলো সৌন্দর্যের ডালি নিয়ে কলুষিত পদচিহ্নগুলো ঢেকে দিচ্ছে। কিন্তু পাথরের পর পাথর দিয়ে তৈরি করা কেল্লা কিছুই নয়। এর দীপ্তি নেই। মাধবীলতার সুন্দর ছায়াটিও এর চেয়ে প্রকাশমান। এ প্রকাশই সাহিত্য।
সাহিত্য তো তাজমহলের মতো, সম্রাট শাহজাহানের হৃদয়ে তার প্রেম, তার বিরহবেদনার আনন্দ তার অন্তরকে স্পর্শ করেছিল। আর এ স্পর্শকে তিনি প্রকাশ করেছেন। তার প্রকাশেই তৈরি হয়েছে এ মহান স্থাপত্য। রবীন্দ্রনাথের ভাষায়- "তার সিংহাসনকে তিনি যে কোঠাতেই রাখুন তিনি তাঁর তাজমহলকে তাঁর আপন থেকে মুক্ত করে দিয়ে গেছেন।" শাহজাহান তাজমহল তৈরির জন্য তার কোষাগার উন্মুক্ত করলেন। সিংহাসনের দিকে দেখলেন না। তিনি তার অন্তর হতে তাজমহলকে উন্মক্ত করতে চাইলেন। আর উন্মুক্ত করে গেলেন বলেই তাজমহল আজও প্রকাশমান। সে আজও দীপ্তি ছড়াচ্ছে। কিন্তু সিংহাসন এবং কোষাগার দীপ্তি হারিয়েছে। সাহিত্যও তাই। মানব মনের আবেগ, বিরহের এবং রোমান্টিকতার প্রকাশই হলো সাহিত্য, স্থাপত্য, চিত্র ইত্যাদি।
টাকার মধ্যে ঐশ্বর্য আছে। কিন্তু এ ঐশ্বর্য কোথায়! এ ঐশ্বর্য হলো যেখানে একান্ত প্রয়োজনকে উত্তীর্ণ হয়ে যায়, যেখানে টাকা পকেটের মধ্যেই প্রচ্ছন্ন নয়, যেখানে প্রয়োজন মিটিয়ে সমাপ্ত হয়ে যাচ্ছে না সেখানেই অশেষের আবির্ভাব, সেখানেই প্রকাশ। জ্ঞানও তাই, প্রয়োজন মিটিয়েই যা নিঃশেষ হচ্ছে না তাই প্রকাশ পায়। আর এ প্রকাশের মাধ্যমই সাহিত্য, আর্ট, শিল্পকলা ইত্যাদি। এ প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ বলেন, "সে যখন অশেষকে স্বীকার করে তখনই সে কোনো একজন অমুক বিশেষ লোকের ভোগ্যতার মলিন সম্বন্ধ হতে মুক্ত হয়। অশেষের প্রসাদ-বঞ্চিত সেই বিশেষভোগ্য টাকার বর্বরতায় বসুন্ধরা পীড়িত।" এ পীড়ন যেন দৈন্যের ভাবের মতোই। এ টাকা দৈন্যের বাহন হলে এর চাকার নিচে কত মানুষ পিষ্ট হয় তার অন্ত নেই। এ দৈন্যের নামই প্রতাপ। এটি স্বীকার করাই হলো প্রকাশ।
বসন্তের ফুলের মুকুল রাশি রাশি ঝরে গেলেও ভয়ের কিছু নেই। কারণ এর ক্ষয় নেই, ফুল অনন্ত। একের পর এক আগমন ঘটবে তার। বসন্তের ডালিতে অমৃতের মন্ত্র আছে। যার দ্বারা রূপের নৈবেদ্য ভরে ওঠে। সৃষ্টির প্রথমদিকে ভূমিকম্পের মহিষ তার শিঙের আক্ষেপে ভূতল হতে উত্তপ্ত লাভার বিচ্ছুরণ ঘটালো বিষ্ণু তা নিঃশেষ হলো। পৃথিবীর প্রাক্কালের নানা অনুষঙ্গই আজ বিলীন মেঘাচ্ছন্ন আকাশকে দংশন কর অগ্নিনাগিনীদের মতোই সেসব আজ বিলীন। কিন্তু বসন্ত তার হাতের অমৃতের ডালা এখনো মেলে ধরে আছে। তাইতো কচি কচি শ্যামল ঘাসের কোমল চুম্বন আকাশের নীলিমাকে জুড়িয়ে দিচ্ছে।
বসন্ত অনন্তের মতোই। তার অমৃত অফুরান। আর এ অমৃত নিয়েই সে বছরান্তে আসে। আর মাঝখানের বিরতিকে ভুলিয়ে রাখে। তাইতো ক্ষুদ্র কন্টিকারির ফুলও তার নিজস্ব দীপ্তিতে দীপ্তিমান। সে পৃথিবীর বড় বড় পালোয়ানদেরও ভয় করে না। অন্তরের আনন্দের মধ্যে যে বিরাজ করে। যখন থাকে না তখনও অন্তরে থাকে। কারো ধারণার ওপর তার আশ্রয় নয়। আর সাহিত্যিকের এ চিন্তাই সাহিত্যে প্রকাশ পায়। সাহিত্যিক ফুলকে সর্বদা জীবিত রাখেন। আর এতেই তার সাহিত্য হয় প্রাকৃতিক উপাদানে ঋদ্ধ।
উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রাষ্ট্র, সমাজ, ইতিহাস, ধর্ম ইত্যাদি সম্পর্কিত চিন্তনের মতো সাহিত্য সম্পর্কিত চিন্তনও তার মহিমার সমান। তিনি তার 'সাহিত্য' প্রবন্ধটিতে নানা প্রতীক এবং উদাহরণ প্রয়োগে সাহিত্যের স্বরূপ দেখিয়েছেন। মানবাত্মার তিন রূপ আমরা আছি, আমরা জানি এবং আমরা প্রকাশ করি- এর মধ্য দিয়ে তিনি সাহিত্যের স্বরূপ ব্যাখ্যা করেছেন। সাহিত্য সৃষ্টি হয় মানুষের 'আমরা প্রকাশ করি' রূপটি থেকেই।