পঠিত প্রবন্ধ অবলম্বনে রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যভাবনা সম্পর্কে আলোচনা কর
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রতিভাবান ব্যক্তিত্ব। তিনি সৃষ্টিশীল লেখক, তার অসামান্য সৃষ্টিশীলতার পরিচয় তার রচিত সাহিত্যকর্ম, গান, নাটক ইত্যাদির মাঝে বিদ্যমান। তিনি তার অসাধারণ লেখনীর বলে প্রতিটি রচনাকে পাঠকের হৃদয়গ্রাহী করে তুলেছেন।
নারী (১৯৩৬) প্রবন্ধের আলোকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সমাজ সভ্যতায় নারীর গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানের কথা নির্দেশ করতে গিয়ে তার জীবাদ্দশায় দেখা নারীর অগ্রগতির ইতিহাসের নিগুঢ় পর্যালোচনা করেছেন। মানুষের সৃষ্টিতে নারী পুরাতনী। নৱ সমাজে নারী শক্তিকে বলা যেতে পারে আদ্যাশক্তি। এই সেই শক্তি যা জীবলোকে প্রাণকে বহন ও পোষণ করে। গৃহে নারী যেমন প্রবেশ করেছে কোথা থেকে অবতীর্ণ হলো গৃহিণী। শিশু যখন মায়ের গেলে আসে ঠিক তখনই মা প্রস্তুত। প্রকৃতির সমন্ত সৃষ্টিশীল প্রক্রিয়া গভীর গোপন, তার দ্বিধাহীন স্বতঃপ্রবর্তনা। নারীর স্বভাবের মধ্যে সেই আদি প্রাণের পরিবর্তন দেখা যায়। সেই জন্য নারীর স্বভাবকে মানুষ রহস্যময় আখ্যা দিয়েছে। মানবসংসারকে গড়ে তোলবার, বেঁধে রাখবার এই আদিম রাঁধুনী হচ্ছে নারী। এই সেই সংসার যা সকল সমাজের, সকল সভ্যতার মূলভিত্তি, তাই প্রবন্ধকার বলেন, "সংসারের এই গোড়াকার বন্ধন না থাকলে মানুষ ছড়িয়ে পড়ত আকার-প্রকারহীন বাষ্পের মতো; সংথত হয়ে কোথাও মিলিত হতে পারত না, সমাজ বন্ধনের এই প্রথম কাজটি করতে হয় মেয়েদের।"
প্রথম জীবনে নারী ছিল গৃহবন্দি, সুদূর অতীতকাল থেকে পুরুষের হাতে মানবসভ্যতার ব্যবস্থার ভার ছিল। সমাজ শাসন, রাষ্ট্রনীতি, অর্থনীতি সর্বদাই পুরুষের একচ্ছত্র অধিকার ছিল। পুরুষ রচিত সভ্যতার আদিকাল থেকে এই রকম ভাঙা আর গড়া চলছে। পুরুষ তার আপন জগতে বারে বারে নতুন আগন্তুক। আজ পর্যন্ত কত বার সে গড়ে তুলেছে আপন বিধিবিধান। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেন, পুরুষ তার সভ্যতা দুর্গের ইট তৈরি করে নিরন্তর নরবলির রক্তে, ধনিকের ধন উৎপন্ন হয় শ্রমিকের প্রাণ শোষণ করে, প্রতাপশালীর প্রতাপের আগুন জ্বালানোন হয় দুর্বলের রক্তের আহুতি দিয়ে, প্রজাদের রজ্জুবন্ধ করে চালানো হয় রাষ্ট্র স্বার্থের রথ, সহজ-ঐশ্বর্যবান দেশকে বলবান নিজের একান্ত প্রয়োজনে আত্মসাৎ করে রাখতে চায়। মেয়েদের নৈপুণ্য যদিও বহন করেছে রস, কিন্তু সৃষ্টির কাজে আজও যথেষ্ট সার্থক হয়নি। আবিলবুদ্ধি মূঢ়মতি পুরুষ শিশুকাল থেকে মেয়েদের হাতে গড়া এবং তারাই মেয়েদের প্রতি সবচেয়ে অত্যাচারী। ক্ষমতার দ্বারা চালিত এ সভ্যতায় সৃষ্টি এবং মমতার স্থান অল্প। কিন্তু নারী তার সহজাত বৈশিষ্ট্যের কারণে পুরুষের বশ্যতাকে মেনে নিতে বাধ্য হয়- "মেয়েদের হৃদয়মাধুর্য ও সেবানৈপুণাকে পুরুষ সুদীর্ঘকাল আপন ব্যক্তিগত অধিকারের মধ্যে কড়া পাহারায় বেড়া দিয়ে রেখেছে। মেয়েদের নিজের স্বভাবেই বাঁধন- মানা প্রবণতা আছে, সেই জন্যে এটা সর্বত্রই এত সহজ হয়েছে।" পুরুষশাসিত সমাজের রূপের সীমাবদ্ধতার কথা উল্লেখ করে প্রবন্ধকার বলেছেন, নতুন সভ্যতা বিনির্মাণে নারীরা এখন সর্বত্রই অগ্রগামী এবং প্রস্তুত। এতদিন নারীদের পাশে গড়ে ওঠা বেড়া নারীরা ভেঙে বাইরের জগতে বেরিয়ে পড়েছে। আপন-আপন ভৌগোলিক ও রাষ্ট্রীয় প্রাচীরের মধ্যে নারীদের কর্ম-চিন্তা আজ বন্দি নেই- উন্মুক্ত বাতাসে আজ তাদের নিশ্বাস এবং কাজের ছাপ। তাই প্রাবন্ধিক বলেন- এ দিকে প্রায় পৃথিবীর সকল দেশেই মেয়েরা আপন ব্যক্তিগত সংসারের গণ্ডি পেরিয়ে আসছে। আধুনিক এশিয়াতেও তার লক্ষণ দেখতে পাই। তার প্রধান কারণ সর্বত্রই সীমানা ভাঙার যুগ এসে পড়েছে। স্বতই অভিজ্ঞতার ক্ষেত্র প্রশস্ত হয়েছে, দৃষ্টিসীমা চিরাভ্যন্ত দিগন্ত পেরিয়ে গেছে। বাহিরের সঙ্গে সংঘাতে অবস্থার পরিবর্তন ঘটছে, নতুন নতুন প্রয়োজনের সঙ্গে আচার বিচারের পরিবর্তন অনিবার্য হয়ে পড়েছে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলা সাহিত্যের অসাধারণ ব্যক্তিত্ব। তিনি মহাকবি কালিদাসের 'মেঘদূত' কাব্যের অনুষঙ্গ নিয়ে তার 'মেঘদূত' প্রবন্ধটি রচনা করেছেন। কালিদাসের 'মেঘদূত' কাব্যে কুবের তার ধনরক্ষক যক্ষকে কাজে অবহেলার কারণে রামগিরি পর্বতে নির্বাসিত করেন। কিন্তু যক্ষের প্রেয়সী অলকা নগরীতে রয়ে যায়। এ দুজনের বিরহগাথাই 'মেঘদূত' কাব্য। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের 'মেঘদূত' প্রবন্ধ আর কালিদাসের 'মেঘদূত' কাব্য অবলম্বনেই বর্তমানের বিরহগাথা।
কালিদাসের 'মেঘদূত' কাব্যের বিরহকে ধারণ করে রবীন্দ্রনাথ বিরহী হৃদয়ের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিশ্লেষণ করেছেন তার 'মেঘদূত' প্রবন্ধে। 'মেঘদূত' প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ প্রতিটি মানুষের বিরহের চিত্র এঁকেছেন। রবীন্দ্রনাথ প্রথমেই রামগিরি এবং হিমালয়ের বিরহ দেখিয়েছেন। সেখানকার স্মৃতি রোমস্থন করেছেন। আর এ স্মৃতি বিরহকাতর স্মৃতি। কারণ যেখান থেকে আমরা চিরকালের মতো নির্বাসিত হয়েছি।
'মেঘদূত' কাব্যে বর্ণিত প্রাচীন ভারতবর্ষের সাথে আমাদের বিরহ ঘটেছে। খোনকার নদী-গিরি-নগরীর নামগুলো অনেক সুন্দর ছিল। অবন্তী, বিদিশা, উজ্জয়িনী, বিন্ধ্য কৈলাস, দেবগিরি, রেবা, সিপ্রা, বেসবতীদ্র এ নামগুলোর মধ্যে শোভা সম্ভ্রম শুভ্রতা আছে। কিন্তু সময় পার হওয়ার সাথে সাথে ভাষা ব্যবহারেও এসেছে ভিন্নতা। অপভ্রংশের ফলে শোভামণ্ডিত নামগুলোর সাথে সৃষ্টি হয়েছে দূরত্ব। 'মেঘদূত' কাব্যের যক্ষের বিরহকেই রবীন্দ্রনাথ ব্যাপক অর্থে মানুষের বিরহরূপ দান করেছেন। যক্ষ রামগিরি হতে মেঘকে দূত করে তার প্রেয়সীকে বার্তা পাঠাত আর এখন আমরা পাশাপাশি থেকেও একে অন্যে আলাদা, যেন যোজন যোজন দূরে। আমাদেরও যেন মেঘকে দূত করে বার্তা - পাঠাতে হয়। প্রিয়ার সাথে আমরা মিলিত হতে চাই সে তার নিজ রাজ্যে বিচরণ করছে যেখানে সশরীরে উপস্থিত হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। শুধু কল্পনাকেই পাঠানো যায়। শুধু ভাষার ভাবে, আভাসে ইঙ্গিতে, ভুল-ভ্রান্তিতে আলো-আঁধারে, দেহ মনে, জন্ম-মৃত্যুর দ্রুততর স্রোতবেগের মধ্যে তার কিছুটা বাতাস পাওয়া যায়। রবীন্দ্রনাথ এক ইংরেজ কবির প্রসঙ্গ এনে দেখিয়েছেন মানুষের বিচ্ছিন্নতার চিত্র। মানুষ এক একটি বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতো যেগুলো এক সময় একই মহাদেশে ছিল কিন্তু কালের আবর্তে বিচ্ছিন্ন। আর এ বর্তমান চেহারার দিকে তাকিয়ে অতীতকে কল্পনা করলেই মনে পড়ে যায় সেই সিপ্রাতীরে যূথীবনে রমণীরা ফুল তুলত। বৃদ্ধগণ উদয়নের গল্প বলত। আষাঢ়ের প্রথম মেঘ দেখে প্রবাসীগণ নিজ নিজ বধুর জন্য ব্যাকুল হতো। আমাদের মধ্যে মনুষ্যত্বের নিবিড় ঐক্য আছে। কালিদাসের মেঘদূতের মাধ্যমে জানতে পেরে আমরা সেখানে কল্পনার মেঘদূত প্রেরণ করেছি। কারণ সেখানে যাওয়ার কোনো উপায় নেই। অনন্তকালের বিরহলোকে প্রিয়ার নিকট হতে যদি একটুখানি দক্ষিণা হাওয়া এসে লাগে এটাই চরম সৌভাগ্য। আমরা প্রত্যেকেই একাকী দাঁড়িয়ে উত্তরমুখী হয়ে চেয়ে আছি। যদি প্রিয়ার মানসলোকে প্রবেশ করা যায়। কিন্তু মাঝখানের নানা উপাদান তার দূরত্বটা বুঝিয়ে দেয়। 'মেঘদূত' কাব্যে কালিদাস দেখিয়েছেন যক্ষের বিরহ আর রবীন্দ্রনাথ দেখিয়েছেন সেই বিরহের ব্যাপ্তি। রবীন্দ্রনাথ মনে করেন আমরা যেন কোনো এককালে এক মানসলোকে ছিলাম, কিন্তু সেখান হতে নির্বাসিত হয়েছি। তাই প্রাবন্ধিক বৈষ্ণব কবির উদ্ধৃতি দেন- "তোমার হিয়ার ভিতর হইতে কে কৈল বাহির! একী হইল। যে আমার মনোরাজ্যের লোক, সে আজ বাহিরে আসিল কেন।" কালিদাসের 'মেঘদূত' কাব্যের প্রাচীন পৃথিবী। তাই আজ তারা সবাই বিরহে কাতর, এক হতে চাইছে কিন্তু দূরত্ব যেন বেড়ে গেছে। দ্বীপের মতোই তারা আলাদা মহাদেশের হয়ে গেছে যার মাঝখানে অতলস্পর্শী সমুদ্র। রবীন্দ্রনাথ আশা রাখেন যে হয়তো স্বপ্নলোকের প্রিয়ার সাথে তার সাক্ষাৎ হবে যদি সত্য ও কল্পনার মধ্যে প্রভেদ হারায়।
সভ্যতার সংকট রবীন্দ্রনাথ (১৮৬১-১৯৪১) দেশীয় ও আন্তর্জাতিক রাজনীতি নিয়ে দূরদর্শী প্রবন্ধ লিখেছেন। 'কালান্তর' প্রবন্ধ সংকলনটি তারই প্রমাণবাহী। এখানে তার রাজনৈতিক দার্শনিকতার পরিচয় রয়েছে। কালান্তরে'র একটি অতি তাৎপর্যপূর্ণ প্রবন্ধ হলো 'সভ্যতার সংকট' (১৯৪১)। আশি বছর যেদিন কবির পূর্ণ হয়েছে, সেদিন তিনি প্রবন্ধটি লিখেছেন। নিজের আশি বছরে পা দিয়ে জীবনের শুরুতে ইংরেজ সম্পর্কে যে ধারণা এবং বিশ্বাস নিয়ে তিনি জীবন অতিবাহিত করেছিলেন আজ আর তা নেই। তার মধ্যে এবং দেশের মনো বৃত্তির মধ্যে তিনি দ্বিখণ্ডিত ভাব দেখতে পান। তার ভাষায়, "পূর্বতম দিগন্তে যে জীবন আরম্ভ হয়েছিল তার দৃশ্য অপর প্রান্ত থেকে নিঃসক্ত দৃষ্টিতে দেখতে পাচ্ছি এবং অনুভব করতে পারছি যে, আমার জীবনের এবং সমস্ত দেশের মনোবৃত্তির পরিণতি দ্বিখণ্ডিত হয়ে গেছে। সেই বিচ্ছিন্নতার মধ্যে গভীর দুঃখের কারণ আছে।" এখানেই রবীন্দ্রনাথের মোহভঙ্গের চিত্র পাওয়া যায়। যে বিশ্বাস নিয়ে তিনি ইংরেজদের জানতেন সে বিশ্বাসে ফাটল পরিলক্ষিত হয় প্রবন্ধের শুরুতেই। রবীন্দ্রনাথ পারিবারিকভাবেই সাহিত্যপ্রেমী ব্যক্তি। তাই ইংরেজ সাহিত্যের মাধ্যমেই তিনি পরিচিত হন ইংরেজ জাতির সাথে এবং জানতে পারেন তাদের ইতিহাস। তিনি ইংল্যান্ডে গিয়ে তাদের সাথে মিশলেন এবং তাদের উদার মানসিকতার পরিচয় পান। ইংরেজ শাসকদের বক্তৃতায়ও উদারতার পরিচয় পাওয়া যায়। জন ব্রাইটের বক্তৃতায় তার উদারতার বাণী রবীন্দ্রনাথ শুনতে পান। তার ভাষায়, "সেই বক্তৃতার হৃদয়ের ব্যাপ্তি জাতিগত সকল সংকীর্ণ সীমাকে অতিক্রম করে যে প্রভাব বিস্তার করেছিল সে আমার আজ পর্যন্ত মনে আছে এবং আজকের এই শ্রীভ্রষ্ট দিনেও আমার পূর্ব স্মৃতিকে রক্ষা করছে।"
রবীন্দ্রনাথ দেখেছেন যে, ইংরেজ শাসিত ভারতবর্ষের মানুষের অবস্থা হৃদয়বিদারক। এখানে মানুষ দৈনন্দিন মৌলিক চাহিদাগুলো পাচ্ছে না। তিনি মনে করেন, জনগণের এমন দৈন্য অবস্থা পৃথিবীর কোনো আধুনিক শাসনচালিত দেশেই থাকতে পারে না। এদেশের দৈন্য অবস্থা অথচ এদেশই দীর্ঘকাল ইংরেজদের ঐশ্বর্য জুগিয়ে আসছে। অথচ এ জাতকে চিরকাল অশিক্ষিত রেখে চিরকাল পরাধীন রাখার পাঁয়তারা করে আসছে ইংরেজরা। প্রবন্ধকার বলেন, "যখন সভ্যজগতের মহিমাধ্যানে একান্ত মনে নিবিষ্ট ছিলেন। তখন কোনোদিন সভানামধারী মানব-আদর্শের এত বড়ো নিষ্ঠুর বিকৃত রূপে করা করতেই পারিনি; অবশেষে দেখেছি, একদিন এই বিকারের ভিতর দিয়ে বহুকোটি জনসাধারণের প্রতি সভ্যজাতির অপরিসীম অবজ্ঞাপূর্ণ ঔদাসীন্য।"
ভারতবর্ষকে তারা সে সভ্যতার আলো থেকে এক পাশে করে রেখেছে। অথচ জাপান যখন যন্ত্রসভ্যতার ছোঁয়া পেল তারা তা সমস্ত জনসাধারণের মধ্যে ছড়িয়ে দিল। রবীন্দ্রনাথ বহুজাতিক শাসনের সুন্দর এবং পরিমার্জিত শাসন দেখতে পান তৎকালীন সোভিয়েত রাশিয়ায়। যেখানে সব জনসাধারণের মধ্যে শিক্ষার বিস্তার সমানভাবে পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে, কোনো জাতিগত বিভেদ তৈরি করা হয়নি সেখানে। সোভিয়েত ইউনিয়নের বিশাল সাম্রাজ্যে কখনো জাতিভেদের ভাগবাঁটোয়ারা নিয়ে বিরোধ ঘটেনি। সকল জাতি মিলিতভাবে সেখানে সহাবস্থান করছে। রবীন্দ্রনাথ তৎকালীন সময়ে বহুসংখ্যক আলাদা জাতির ওপর শাসন করা দুই জাতি সোভিয়েত রাশিয়া এবং ইংরেজদের তুলনা করে উভয়ের শাসনব্যবস্থায় পার্থক্য লক্ষ করেন। দুই জাতির শাসনের দুই বিপরীত চিত্র সোড়িয়েত সেখানে সকল জাতির মধ্যে শিক্ষার বিস্তার ঘটিয়ে এমনকি মরুচর মুসলিমদেরও সমান সুবিধা দিচ্ছে বিপরীতভাবে ইংরেজরা ভারতবাসীকে দলিত করে, এ জাতির পৌরুষ দলিত করে দিয়ে তাকে চিরকালের মতো পরাধীন রাখার ষড়যন্ত্র করছে। যে ইংরেজকে রবীন্দ্রনাথ বিশ্বাসের সাথে, ভক্তির সাথে দেখেছেন, সে ইংরেজকে তিনি ভারতবর্ষের কোথাও দেখেননি। এখানে ভারতবাসীর মধ্যে ইংরেজরা অভাবই তৈরি করেননি; বরং তৈরি করে দিয়েছে নির্মম আত্মবিচ্ছেদ যা ভারতবর্ষের বাইরে কোথাও চোখে পড়েনি। ভারতবাসীকে ইংরেজরা Law and order বা বিধি এবং ব্যবস্থার মধ্যে বেঁধে রাখছে। রবীন্দ্রনাথ ইংরেজদে প্রতি তার বিশ্বাসভঙ্গের কথা প্রবন্ধের শেষদিকে স্পষ্ট স্বরে ব্যক্ত করেন- "জীবনের প্রথম আরম্ভে সমস্ত মন থেকে বিশ্বাস করেছিলুম য়ুরোপের অন্তরের সম্পদ এই সভ্যতার দানকে। আর আজ আমার বিদায়ের দিনে সে বিশ্বাস একেবারে দেউলিয়া হয়ে গেল।" তাইতো রবীন্দ্রনাথ আশা করেছেন পরিত্রাণকর্তা আবির্ভূত হবে, এ নিমর্ম পরিস্থিতি হতে ভারতবাসীকে উদ্ধার করবে। তিনি বিশ্বাস করেন একদিন মানুষ তার নিজের অধিকার পাওয়ার জন্য অগ্রসর হবে এবং সফল হয়ে নিজেদের মর্যাদা ফিরিয়ে নিয়ে আত্মসম্মান পুনঃপ্রতিষ্ঠা করবে।
স্বদেশী সমাজ প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর স্বদেশের সব কাজে বিদেশিদের হস্তক্ষেপকে মানতে রাজি নন। কেননা অনেক আগে থেকেই বাংলা সমাজের সমস্যা সমাজই সমাধান করেছে। কিন্তু ইংরেজরা ক্ষমতায় আরোহণের পর সমাজের সে অধিকার বর্ষ করেছে। প্রবন্ধকার দেখতে পান আমাদের এই বাংলাদেশে যত রাজারই আগমন ঘটেছে বা যুদ্ধবিগ্রহ হয়েছে সমাজের ওপর তার কোনো প্রভাব পড়েনি। জন্মদান থেকে বিদ্যাকাল সবই সমাজের কাজ ছিল। সমাজের কাজগুলো আমাদের শ্বাসপ্রশ্বাসের মতোই স্বাভাবিকভাবে চলে আসছিল। এ প্রসঙ্গে প্রাবন্ধিক বলেন- "নিশ্বাস লইতে যেমন আমাদের কাহাকেও হাতে পায়ে ধরিতে হয় না, রক্ত চলাচলের জন্য যেমন চৌনহল-মিটিং অনাবশ্যক সমাজের সমস্ত অত্যাবশ্যক হিতবার ব্যাপার সমাজে তেমনি স্বাভাবিক নিয়মে ঘটিয়া আসিয়াছে।" পৃথিবীর সকল রাষ্ট্র এক নিয়মে চলে না। একেক রাস্ট্রের পরিচালনার কৌশল একেক রকম। কোনো রাষ্ট্র অস্ত্রশাস্ত্রের মধ্যেই নিজের শক্তি ধারণ করে, আবার কোনো রাষ্ট্র তার সকল উপাদানের মধ্যেই শক্তি কবচ ধারণ করে জয়ী হয়। রবীন্দ্রনাথ মনে করেন যে শিক্ষিতগণ যদি মনপ্রাণ দিয়ে এ মেলার আয়োজন করেন, এ মেলায় যদি হিন্দু-মুসলমানের সম্পর্ক স্থাপন হয়, বিদ্যালয়, পথঘাট, জলাশয়, গোচর-জমি ইত্যাদি সম্পর্কিত জেলার যেসব অভাব আছে তা নিয়ে পরামর্শ করেন তবে স্বদেশ আবার জেগে উঠবে। দেশের যেসব বড় বড় জলাশয় আমাদের জলদান করতো, স্বাস্থ্যদান করতো সেগুলো দূষিত হয়ে শুধু জলকষ্টই তৈরি করেনি, রোগ মৃত্যু বিতরণ করছে। তাই প্রবন্ধকার মন্তব্য করেছেন- "চিরকাল ঘরের লক্ষ্মী আমাদের ঘর নিকাইয়া আসিয়াছেন ম্যুনিসিপালিটির মজুর নয়। ম্যুনিসিপালিপির সরকারি ঝাটায় পরিষ্কার করিয়া দিতে পারে বটে, কিন্তু লক্ষ্মীর সম্মার্জনীতে পবিত্র করিয়া তোলে, এ কথা যেন আমরা না ভুলি।"
সমাজকে জাগ্রত করে কর্তৃত্ব গ্রহণ করতে হবে, রবীন্দ্রনাথ বলেন, "এক্ষণে আমাদের সমাজপতি চাই। তাঁহার সঙ্গে তাঁহার পর্যদসভা থাকিবে, কিন্তু তিনি প্রত্যক্ষভাবে আমাদের সমাজের অধিপতি হইবেন।" তাই সমাজের সবার চোখে একজনকে বড় করে তুলতে হবে। আমাদের সমাজপতিও আমাদের মহত্ত্বে মহৎ হবেন। সমাজের সমস্ত লোকজন তাকে বড় করে তুলবে। সমাজ আমাদের দেশরক্ষা, আত্মরক্ষা এবং সমাজ রক্ষায় উদ্দীপ্ত করবে। ভারতীয় সমাজ আর জলকষ্টের মতো কোনো অভাবে ভুগবে না।
উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সৃষ্টিশীলতা প্রবন্ধে দেশ, সমাজ, রাজনীতি, দেশকে বিদেশি শাসন থেকে মুক্ত করার জন্য সাহিত্যের মাধ্যমে মানুষকে জাগ্রত করেছেন। তিনি বিদেশি শাসন থেকে দেশকে মুক্ত করার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়েছেন। তিনি ইংরেজ জাতিকে বিশ্বাস করেছিলেন। কিন্তু তারাই দেশকে ক্ষতি করার জন্য উঠেপড়ে লেগেছিলেন। তাই তিনি টের পেয়ে মানুষ জাতিকে সজাগ করেছিলেন।