'শিক্ষার মিলন' প্রবন্ধ অনুসরণে রবীন্দ্রনাথের শিক্ষা ভাবনার পরিচয় দাও

রবীন্দ্রনাথের 'শিক্ষার মিলন' প্রবন্ধ অবলম্বনে শিক্ষা সম্পর্কিত চিন্তাধারার পরিচয় দাও
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সমাজনীতি, রাষ্ট্রনীতি, ধর্ম, শিক্ষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি এবং নন্দনতত্ত্ব নিয়ে প্রবন্ধ লিখেছেন। তার লিখিত প্রবন্ধগুলোর অন্যতম প্রধান উপাদান হলো শিক্ষা। শিক্ষা সম্পর্কিত প্রবন্ধগুলোর মধ্যে সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য প্রবন্ধ 'শিক্ষার মিলন'। এ প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথের শিক্ষা সম্পর্কিত ভাবনার বিচ্ছুরণ ঘটেছে। তিনি পৃথিবীর দুই প্রান্তের শিক্ষার মিলন ঘটিয়ে একটি আদর্শ শিক্ষা চেয়েছেন, যাতে উভয়প্রান্তের মানুষই সমানভাবে সভ্য হয়ে উঠতে পারে এবং জাতিগত বিভেদ দূরীভূত হয়।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার জীবনের একটা দীর্ঘ সময় ইউরোপ- আমেরিকায় কাটিয়েছেন। তিনি সেখানকার শিক্ষা-সংস্কৃতি স্বচক্ষে দেখেছেন। আমেরিকায় যখন সাত মাস অবস্থান করেছেন তখন তিনি সেখানকার মানুষের শিক্ষার ফসল অবলোকন করেছেন। পশ্চিমের মানুষ বিশ্বনিয়ম আবিষ্কার করছে, বিজ্ঞান শিখে তারা পৃথিবী শাসন করছে। এর পিছনে যে সত্য কাজ করছে তা হলো তাদের শিক্ষা। এ শিক্ষার জোরেই তারা বসেছে চালকের আসনে। আর তারা ইচ্ছেমতো দাপিয়ে বেড়াচ্ছে সমগ্র পৃথিবী। কারো যদি তাদের মতো দাপিয়ে বেড়ানোর ইচ্ছা হয়, তাহলে দাপিয়ে বেড়ানোর বিদ্যাটা জানতে হবে। এ বিদ্যা কেউ শিখে যদি তার মতো শক্তি অর্জন করতে পারে, এতে তার কোনো ক্ষতি নেই বরং তার জন্যও ভালো।

পশ্চিমে যখন মানুষ যন্ত্রসভ্যতা আবিষ্কার করে নিজেদের প্রভূত উন্নতি করে চলেছে, ভারতবর্ষে তখনো মানুষ জাদুমন্ত্র নিয়ে পড়ে আছে। তারা রোগ হলে ওঝার কাছে দৌড়াচ্ছে, দৈন্যে গ্রহশক্তির কাছে, বসন্ত ঠেকানোর জন্য শীতলা দেবীর দ্বারে যাচ্ছে। অথচ এ সময়েই পশ্চিমারা জাদুমন্ত্রের পিছনে সেঁকো বিষের কারসাজি উদ্‌ঘাটন করে নিয়েছে। এজন্য ওরা ইচ্ছা করলেই মারতে পারে। কারণ তাদের সে বিদ্যা হস্তগত। তাই আমরা ইচ্ছা না করলেও মরতে পারি, কারণ আমরা যে অন্ধ।

পশ্চিমের লোক বিশ্বব্রহ্মান্ডের নিয়ম জেনেছে। তারা জেনেছে যে বিশ্বব্রহ্মান্ডের নিয়মে কোথাও কোনো ত্রুটি থাকতে পারে না। এ বিশ্বাসটাই বৈজ্ঞানিক বিশ্বাস। তারা এ বৈজ্ঞানিক বিশ্বাসের ওপর ভর করেই নিয়মকে চেপে ধরেছে। নিয়মকে তারা তাদের দাস বানাচ্ছে। তাই তারা বাইরের জগতের সব সংকট উতরে যাচ্ছে। অন্যদিকে, যারা জাদুর শরণাপন্ন হচ্ছে তারা সব জায়গায়ই মার খেয়ে মরছে। তাদের ওপরে সর্বদা কর্তা ভর করে থাকে। আত্মশক্তিতে বলীয়ান না হলে নিজের বুদ্ধি সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান না থাকলে সে শক্তিহীন হয়ে পড়ে। আর তখনই সে সবকিছুকে মানতে শুরু করে। রবীন্দ্রনাথের ভাষায়, “বিশ্বব্যাপারে যে মানুষ আকস্মিকতাকে মানে সে নিজেকে মানতে সাহস করে না, সে যখন তখন যাকে তাকে মেনে বসে; শরণাগত হবার জন্যে সে একেবারে ব্যাকুল।" এ

ভীব্রতা থেকে বের হওয়ার একমাত্র মাধ্যম বিজ্ঞানের আলোচনায় মনকে ভয়মুক্ত করা। পশ্চিমারা যখন থেকে মনকে ভয়মুক্ত করেছে, যখন থেকে বিশ্বনিয়ম জেনেছে; তখন থেকেই তারা পলিটিক্যাল স্বাতন্ত্র্যের বিকাশ করেছে। কিন্তু ভারতীয়রা বিজ্ঞানের - আলোচনায় এখনো মনকে ভয়মুক্ত করতে পারেনি।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পৃথিবীর দুইপ্রান্তের দুই চিত্র তুলে ধরে শিক্ষার - গুরুত্ব তুলে ধরেন। এরপর তিনি উপনিষদের শিক্ষার গুরুত্বারোপ করেন। প্রাচীন ভারতীয় এ শিক্ষা মানব মুক্তির মন্ত্র উচ্চারণ - করে। এখানেই বিধাতার বিধি বর্ণিত আছে। সেখানে তিনি বলে দিয়েছেন- বস্তুরাজ্যে তাকে না মানলেও চলবে, অর্থাৎ আমাদের দেবতা পাতানো স্বভাব ছাড়তে হবে। বিশ্বনিয়ম এবং বুদ্ধির নিয়মকে এক করে নিতে হবে। তবেই আসবে মুক্তি; উল্টো হলে চিরকালই পরাধীন থাকতে হবে। প্রাবন্ধিক বলেন, "বিধাতা স্বয়ং যেখানে কর্তৃত্ব দাবি করেন না সেখানেও যারা কর্তা জুটিয়ে বসে, যেখানে সম্মান দেন সেখানেও যারা আত্মাবমাননা করে, - তাদের স্বরাজে রাজার পর রাজার আমদানি হবে, কেবল ছোট্ট ঐ 'স্ব'টুকুকে বাঁচানোই দায় হবে।" - 

রবীন্দ্রনাথ ইতোমধ্যেই প্রমাণ করেছেন, পশ্চিমারা তাদের বিদ্যার জোরেই উচ্চাসনে বসেছে। কিন্তু তিনি সেখানে যে বস্তুর অভাব - দেখেছেন, তা হলো- ঐক্য। সেখানকার মানুষ সম্পর্ককেও - যান্ত্রিক করে তুলেছে। মানুষের বন্ধন যন্ত্রের স্কু বা আধার বন্ধনে মতোই হয়ে উঠেছে। ফলে মানবসমাজ বিশ্লিষ্ট হতে শুরু = করেছে। ঐক্যের অভাবে যান্ত্রিকতা তাদের মধ্যে জেকে বসেছে। কারণ তারা ফললাভের লোভে মত্ত। আর এ লোভের ফলেই মানুষ মানুষকে খাটো করে দেখে। -

এজন্য মানুষের মধ্যে আত্মিক সম্পর্ক খাটো হতে থাকে। তখন - ধন হয় সমাজের রথ, ধনী হয় রথী; আর শক্ত বাঁধনে বাঁধা - মানুষগুলো হয় রথের বাহন। এ রথ ধনলাভের দিক এগিয়ে চলে। এ এগিয়ে চলাকেই পশ্চিমারা সভ্যতার উন্নতি বলে; কিন্তু - এতে মানুষের আনন্দ নেই। তাদের যে দড়ির বাঁধন তা আর - টিকে না। নাড়ির বাঁধন নেই বলেই মানুষ বিদ্রোহী হয়ে ওঠে। এজন্যই পশ্চিমে জাতিতে জাতিতে বিভেদ দেখা দিচ্ছে। তাই বলে এটা বলা যাবে না যে, পশ্চিমারা যে বিদ্যার্জন করেছে তা অসফল। সে বিদ্যা পুরোপুরিই সফল; কারণ সে বিদ্যা তাদের অভাব ঘুচিয়েছে, শাসনযন্ত্র এনে দিয়েছে। কিন্তু ঐক্যটা তারা শিখেনি। তবে এ ঐক্যের শিক্ষা রয়েছে ভারতবর্ষের মুনি ঋষিদের মন্ত্রে। এ দুইয়ে মিলে এক হয়ে গেলেই শিক্ষা পূর্ণতা পায়।

পশ্চিমা মহাদেশের লোকেরা বাহ্যবিশ্বে যে মায়া আছে তা থেকে মুক্তির সাধনা করছে। এ সাধনা তাদের ক্ষুধা, তৃষ্ণা, রোগ দৈন্য দূরীভূত করছে। আর পূর্ব মহাদেশের মানুষ অন্তরাত্মার সাধনা করছে। এ সাধনা অমৃতের সন্ধান লাভের উপায়। এ সাধনায় ঐক্য আছে, কিন্তু দৈন্য জেঁকে বসে আছে। অতএব পূর্ব পশ্চিমের যোগসাধন আবশ্যক। আর এ মিলনমন্ত্র আমাদের উপনিষদ দিয়ে গেছে। রবীন্দ্রনাথ বলেন, "এই মিলনের অভাবে পূর্বদেশ দৈন্যপীড়িত, সে নির্জীব; আর এই মিলনের অভাবে পশ্চিম অশান্তির দ্বারা ক্ষুব্ধ, সে নিরানন্দ।"

পূর্ব মহাদেশের দৈন্য, পশ্চিমের অশান্তি এবং নিরানন্দ দূর করার জন্য উভয় শিক্ষার মিলন ঘটাতে হবে। রবীন্দ্রনাথ মনে করেন, ইতিহাসের ধারায় মানুষ একত্র হয়েছে, কিন্তু এক হতে পারেনি। এক হতে পারলেই মানুষ মহাজাতিরূপে প্রকাশ পায়। এজন্য এক হওয়ার শিক্ষার্জন করতে হবে। তা না হলে বিজ্ঞানের শিক্ষা কল্যাণ বয়ে আনবে না; বরং বিভাজন ডেকে আনবে। বর্তমান যুগের জ্ঞানবিজ্ঞানের প্রসারের সময় মানুষকে একত্রিত হওয়ার পাশাপাশি এক থাকতে হবে। উল্টো হলেই শিক্ষা আর শান্তি আনবে না। তাই প্রাবন্ধিক বলেন, "বর্তমান যুগের সাধনার সঙ্গেই বর্তমান যুগের শিক্ষার সংগতি হওয়া চাই।"

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার 'শিক্ষার মিলন' প্রবন্ধে শিক্ষা সম্পর্কে আরও বলেন, স্বাজাত্যের অহমিকা থেকে মুক্তিদানের শিক্ষাই হওয়া উচিত আজকের দিনের প্রধান শিক্ষা। কারণ ইতিহাসের মোড় নেওয়ার সময় উপস্থিত। এরপরের ইতিহাস হবে সহযোগীর ইতিহাস। এ সহযোগীর ইতিহাস তৈরি করার জন্যই প্রয়োজন পূর্ব পশ্চিমের শিক্ষার মিলন ঘটানো। 

ভারতবর্ষে প্রচলিত শিক্ষায় রবীন্দ্রনাথ ধার করা বিদ্যা দেখতে পান। এখানে পশ্চিমা বিদ্যা ভিক্ষা করে গেলানো হচ্ছে। এতে তিনি ক্ষুণ্ণ হন। কারণ ভিক্ষা করা বিদ্যায় বিদ্যালাভ হয় না; বরং এ বিদ্যা নীচুতা সৃষ্টি করে। তাই বিজ্ঞান এবং অন্তরাত্মার সাধনা মিলে এমন একটা শিক্ষাব্যবস্থা হওয়া চাই, যা পুরো পৃথিবীকে একত্র নয়; এক করবে এবং সেটি ভারতবর্ষের বিদ্যানিকেতনগুলো হতেই যাত্রা করবে বলে রবীন্দ্রনাথ আশাবাদ ব্যক্ত করেন। 

উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার জীবনে শিক্ষা নিয়ে ব্যাপক ভেবেছেন, গবেষণা করেছেন। তিনি পৃথিবীর পূর্ব এবং পশ্চিম মহাদেশের শিক্ষা অবলোকন করে দেখেন, দুই প্রান্তের শিক্ষার দুই ভিন্ন দিক। পশ্চিমের শিক্ষা মানুষের অভাব দূর করছে কিন্তু এক করছে না। অন্যদিকে, পূর্বের সাধনা মানুষকে এক করছে কিন্তু দৈন্য ঘোচাচ্ছে না। তাই তিনি দুইপ্রান্তের শিক্ষাকে মিলিয়ে এক করতে বলেছেন। এতে পূর্বের দৈন্য দূর হবে আবার পশ্চিমের বিচ্ছিন্নতাও থাকবে না। এটাই 'শিক্ষার মিলন' প্রবন্ধের আলোচিত রবীন্দ্রনাথের শিক্ষা ভাবনা।
আপনারঅদৃশ্যমন্তব্য
Cancel