পঠিত প্রবন্ধ অবলম্বনে প্রমথ চৌধুরীর সাহিত্যাদর্শ আলোচনা কর
প্রমথ চৌধুরীর সাহিত্য বিষয়ক প্রবন্ধগুলো সম্পর্কে আলোচনা কর।
বাংলা গদ্যের চলিত রীতিকে ভৎকর্তৃক প্রথম সাহিত্যসৃজনে যিনি প্রয়োগ করেন তিনি হলেন প্রমথ চৌধুরী। তিনি (১৮৬৮- ১৯৪৬) বাংলা ভাষার অন্যতম সাহিত্যিক যিনি বিংশ শতাব্দীর প্রথম ভাগে সক্রিয় ছিলেন। তিনি ছিলেন একাধারে প্রাবন্ধিক, কবি, সাহিত্যিক ও ছোট গল্পকার। তাকে বাদ দিয়ে বাংলা সাহিত্যের কথা কল্পনাও করা যায় না।
প্রমথ চৌধুরী বাংলা গদ্যে চলিত রীতির প্রবর্তক হিসেবে প্রসিদ্ধ হয়ে আছেন। কিছুদিন তিনি কলকাতা হাইকোটে আইন ব্যবসা করেন। 'এছাড়াও তিনি দক্ষিণেশ্বর ও গোপাল লাল অ্যাস্টেটের রিসিভার এবং ঠাকুর অ্যাস্টেটের ম্যানেজার পদে দায়িত্ব পালন করেন।
'ভারতী' পত্রিকায় প্রকাশিত হালখাতা তার চলিত রীতির প্রথম গদ্য রচনা (১৯০২)। বাংলা সাহিত্যে চলিত ভাষার প্রবর্তক হিসেবে ও বিদ্রূপাত্মক প্রাবন্ধিক হিসেবে তিনি চিরস্বণীয় ব্যক্তিত্ব। তার তেল-নুন-লাকড়ি, সবুজপত্র, নানাকথা, রায়তের কথা, নানাচর্চা, প্রবন্ধ সংগ্রহ (১ম খন্ড-১৯৫২ ও ২য় খন্ড-১৯৫৩) প্রভৃতি বাংলা সাহিত্যের এক অমূল্য সম্পদ। নিম্নে কতিপয় প্রবন্ধ অবলম্বনে প্রথম চৌধুরীর সাহিত্যের উদ্দেশ্য ও আদর্শ সম্পর্কে আলোকপাত করা হলো:
১. সবুজপত্র: এ প্রবন্ধটি প্রমথ চৌধুরীর বাঙালির আত্মসমালোচনা ও যৌবন ধর্মের প্রবন্ধ। এ প্রবন্ধে তিনি বিপরীত ধারার মাঝে আত্ম আবিষ্কার ও গতিবাদকে কামনা করেছেন। প্রমথ চৌধুরী সাহিত্য ও জীবন উভয় ক্ষেত্রেই তারুণ্যকে প্রাধান্য দিয়েছেন। তিনি পুরাতনকে বর্জন করে নতুনকে আবিষ্কার করেছেন। জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ সময় যৌবন। যৌবনের সবুজ প্রকৃতিকে উজ্জীবিত করার কোনো প্রবণতা নেই আমাদের দেশের কবি সাহিত্যিকদের। আমাদের দেশের জ্ঞানীরা আমাদের রাতারাতি পাকা করে গড়ে তুলতে চান। অপরদিকে কবির দল সবুজকে প্রকাশ করতে বিমুখ। কবির দল কাঁচাকে কচি করতে চান। এরা চান যে আমরা শুধু গদগদভাবে আধ-আধ কথা কই। এদের রাগ সবুজের সজীবতার উপর।
সাহিত্যে যৌবনকে প্রতিষ্ঠার কোনো প্রবণতা নেই আমাদের দেশের কবি সাহিত্যিকদের। তারুণ্যের স্বাভাবিক বিকাশকে বিঘ্নিত করছে এদেশের কবি সাহিত্যিক এবং জ্ঞানীরা। আমাদের সাহিত্যে কোনো জীর্ণতা, জড়তা, সংস্কার থাকবে না। জ্ঞান বিকাশের দ্বার উন্মুক্ত থাকবে। বিশ্বের জ্ঞান অবারিত দ্বারা দিয়ে আমাদের সাহিত্যের মন্দিরে প্রবেশ করবে। প্রমথ চৌধুরীর মতে, "শুধু তাই নয়, এ মন্দিরে সকল বর্ণের প্রবেশের সমান অধিকার থাকবে। উষার গোলাপি আকাশের নীল, সন্ধ্যার লাল। মেঘের নীল লোহিত, বিরোধালংকার স্বরূপে সবুজপত্রের গাত্রে সংলগ্ন হয়ে তার নরক দ্যুতি কখনো কোমল করে তুলবে। সে মন্দিরে স্থান হবে না। কেবল শুষ্ক পত্রের।"
ছায়া ঢাকা, মায়া ভরা আমাদের বাংলাদেশের রং ও সবুজ। চারিদিকে বেষ্টন করে আছে সবুজ। এ সবুজ আবহে লালিত এদেশের মানুষের মনের রংও সবুজ। মূলত সবুজ রংটি সূর্যের সাতটি রঙের মধ্যমণি। আমাদের বৃক্ষ পত্রগুলোতে যে সবুজ রংটি ধরে আছে এর রসে আছে তৈজ রং ও যৌবন। সবুজ শুধু বাংলাদেশ জুড়ে রং নয় বারো মাসের রং। আমাদের প্রকৃতি বহুরূপী রং নয় তাই মাধব হতে মধু মাস পর্যন্ত একই রং বিস্তার করে। ঋতু পরিবর্তনের সে রূপ পরিবর্তিত হয় তা আমাদের মনে। তবে আমাদের দেশে রং এর অভাব নেই, জলে, স্থলে, আকাশে, মেঘে ছড়িয়ে আছে বিচিত্র রং- তবে সমস্ত রং ক্ষণস্থায়ী। আসল রং সবুজ যা চিরস্থায়ী। এ রংটি রং মাত্র নয় এটি রূপকও বটে। এটি রূপর হিসেবে প্রকাশ করে তেজ, তারুণ্য ও যৌবন। মূলত প্রমথ চৌধুরী সবুজ পত্র প্রবন্ধের মধ্য দিয়ে সাহিত্যের অপরূপ প্রাণলীলা, অবারিত প্রাণ শক্তি প্রতিষ্ঠার কথা ব্যক্ত করেছেন।
২. সাহিত্যে খেলা: সাহিত্যের উদ্দেশ্য সকলকে আনন্দ দেওয়া, কারো মনোরঞ্জন করা নয়। এ কথাই প্রমথ চৌধুরী বলেছেন সাহিত্যে খেলা প্রবন্ধে। সাহিত্য যদি আনন্দ দানের জন্য রচিত হয় তাহলে সেটি উচ্চ শ্রেণির সাহিত্য শিল্প হবে। আর সাহিত্য যদি উদ্দেশ্য অর্থ লাভের চিন্তা, অপরের মনোরঞ্জনের আকাঙ্ক্ষা থাকে তাহলে সেটি নিম্নমানের সাহিত্যে পরিণত হবে। এ দুয়ের ভিতর যে আকাশ-পাতাল প্রভেদ আছে, সেটি ভুলে গেলেই লেখকেরা নিজে খেলা না করে পরের জন্য খেলনা তৈরি করতে বসেন।
৩. যৌবনে দাও রাজটিকা: এ প্রবন্ধটিই যৌবন ও সাহিত্য চিন্তা বিষয়ক ফসল। যৌবন মানবজীবনের শ্রেষ্ঠ সময়। এসময় জীবন পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে, যেমন বসন্ত এলে প্রকৃতি ফুলে ফসলে ভরে ওঠে শীতের জরাজীর্ণতা অতিক্রম করে। আমরা প্রকৃতির এ বসন্তকে কামনা ও লালন করলেও জীবনের বসন্তকে আমাদের সমাজে ভালো চোখে দেখা হয় না। যৌবনকে দেখা হয় বৃহৎ ফাঁড়া হিসেবে। এ কারণে আমাদের শিক্ষাগুরু, ধর্মঠাকুর, সবার উপদেশ যৌবনকে এড়িয়ে চলো। অন্যথা যৌবন ও বসন্ত এ দুয়ের আবির্ভাব যে একই দেব শক্তির লীলা এরূপ একটি বিশ্বাস আমাদের মনে স্থান লাভ করতে পারে। তাই আমরা এক লক্ষে বাল্য হতে। বার্ধক্যে উত্তীর্ণ হই। আমাদের দেশের প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থাও এ ব্যাপারে সাহায্য করে। যেমন, "তাই আমাদের শিক্ষানীতির উদ্দেশ্য হচ্ছে ইচড়ে পাকানো, আর আমাদের রাজনীতির উদ্দেশ্য হচ্ছে জাগ দিয়ে পাকানো।" এর ফলে আমাদের জীবনে সূচনা, উপসংহার আছে কিন্তু মাঝখানটা ফাঁকা, শূন্য।
আমরা যে যৌবনকে গোপন রাখতে চাই এর জন্য সংস্কৃত সাহিত্যের প্রভাব অনেকাংশে দায়ী। সংস্কৃত কবিরা যৌবনকে যেভাবে প্রত্যক্ষ ব্যাখ্যা করেছেন তাতে যৌবন শুধু ভোগের সময় মনে করেছেন। সে কারণে তাদের কাব্যের পাতায় পাতায় প্রকৃতিকে নারীরূপে স্থাপন করেছেন। তাতে ফুটে উঠেছে ভোগবিলাসের চিত্র। কিন্তু যৌবনের যে ত্যাগের মহিমা আছে, তা তারা খুঁজে পায়নি। লেখক অভিমত প্রকাশ করেন। প্রাবন্ধিকের মতে "ভোগের ন্যায় ত্যাগও যৌবনের ধর্ম। বার্ধক্য কিছু অর্জন করতে পারে না বলে কিছু বর্জনও করতে পারে না। বার্ধক্য কিছু কাড়তে পারে না বলে কিছু ছাড়তেও পারে না।"
একথা সত্য যে, আমরা যৌবনকে যত ভয় পাই না কেন, যৌবনের ভোগের ধর্মটা পুরোপুরি চরিতার্থ করতে চাই। আমাদের কামনার যৌবন দেহের যৌবন। কিন্তু এ যৌবন ক্ষণস্থায়ী। তবে যৌবনকে দীর্ঘ করার জন্য সমাজে সৃষ্টি হয়েছে বাল্য বিবাহ, যা জীবনের ষোলোআনা ভোগের নিশ্চয়তা দেয়নি, বরং ডেকে এনেছে অকাল মৃত্যু। এ কারণে প্রমথ চৌধুরী যৌবনের পূজারি হলেও তিনি মনের যৌবনের পক্ষপাতী। এখানেই সম্ভর মানসিক বিকাশ, পুরাতন এবং জড়তা থেকে মুক্তি। সমাজে বাল্যকাল থেকে বার্ধক্য পর্যন্ত নিত্য প্রাণ প্রবাহ আছে এর মধ্যে গতিশীলতা আছে এগুলো আমাদেরকে ধারণ করতে হবে। এগুলো আবার ফিরিয়ে দিতে হবে সবার মধ্যে প্রাণ প্রতিষ্ঠা করে। প্রমথ চৌধুরী এগুলো সমাজে সাহিত্যে প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছেন। লেখকের কথায়, "একের দেহের যৌবন অপরের দেহে প্রবেশ করিয়ে দেবার জো নেই। কিন্তু একের মনের যৌবন লক্ষ লোকের মনে সংক্রমণ করে দেওয়া সম্ভব।"
প্রমথ চৌধুরী সাহিত্যে মানসিক যৌবন প্রতিষ্ঠার কথাই বলেছেন। তার মতে যৌবন দুই প্রকার। যথা: শারীরিক এবং মানসিক। শারীরিক যৌবন সময়ের ব্যবধানে নিঃশেষ হয়ে যায়। কিন্তু মানসিক যৌবন শেষ হয় না। মানসিক যৌবন অমর অবিনাশ। মানসিক যৌবন এক সমাজ থেকে অন্য সমাজে, এক সাহিত্য থেকে অন্য সাহিত্যে স্থানান্তর করা সম্ভব। সাহিত্যের মাধ্যমে যৌবনাদর্শের কথা মানুষের সম্মুখে তুলে ধরা সম্ভব। প্রাবন্ধিক বলেন "মানবজীবনের পূর্ণ অভিব্যক্তি যৌবন। যৌবনে মানুষের বাহ্যেন্দ্রিয়, কর্মেন্দ্রিয় ও অন্তরিন্দ্রিয় সব সজাগ ও সবল হয়ে ওঠে এবং সৃষ্টির মূলে যে প্রেরণা আছে, মানুষের সেই প্রেরণা তার সকল অঙ্গে, সকল মনে অনুভব করে।" সুতরাং এই যৌবনের কপালেই আমাদের সাহিত্যিকদের রাজটিকা দিয়ে ব্যক্তি জীবনে তা প্রতিষ্ঠা করতে প্রয়াস চালাতে হবে।
উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায়, প্রমথ চৌধুরী তার প্রবন্ধগুলোতে সাহিত্যের আকার আকৃতি আদর্শ অনুসঙ্গ উদ্দেশ্য প্রভৃতি বিষয়ে সুচিন্তিত মতামতের ভিত্তিকে যৌক্তিকভাবে উপস্থাপন করেছেন। তিনি সাহিত্যের মাধ্যমে প্রচলিত শিক্ষা বাদ দিয়ে যেখানে রসের দুয়ার অবারিত করে সবুজের কামল করেছেন। শিল্পের সৌন্দর্যগুণ ও আদর্শপুণই প্রাধ্যান্য পেয়েছে তার চিন্তায়।