বাংলা ভাষা সম্পর্কে প্রমথ চৌধুরীর বক্তব্য উপস্থাপন কর

বাংলা ভাষা সম্পর্কে প্রমথ চৌধুরীর বক্তব্য উপস্থাপন কর
বাংলা সাহিত্যের এক উজ্জ্বল নক্ষত্রের নাম প্রমথ চৌধুরী। তিনি বাংলা সাহিত্যের চলিত গদ্যরীতির প্রবর্তক। বাংলা সাহিত্যে তার অবদান অনস্বীকার্য। তিনি বীরবল ছদ্মনামে পরিচিত ছিলেন। বাংলা ভাষা সম্পর্কে প্রমথ চৌধুরীর তুলনামূলক বক্তব্য নিম্নে উপস্থাপন করা হলো: তিনি বিভিন্ন কাব্য, সাহিত্য ও প্রবন্ধ রচনা করেছেন। 'জয়দেব' প্রবন্ধে প্রাবন্ধিক গীতিকবি জয়দেব 'গীতগোবিন্দ' কাব্যের বিষয় এবং কাব্যাংশের দোষগুণ নির্ণয় করেছেন কাব্য স্বরূপে। বঙ্গীয় রাজা লক্ষ্মণসেনের সময়ে বঙ্গদেশের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অবস্থার সম্যক নির্ধারণের পক্ষে উপযুক্ত ছিল না। এ কারণে প্রমথ চৌধুরী 'গীতগোবিন্দ' কাব্য থেকে মূল ঐতিহাসিক তত্ত্বের আলোকে কাব্যটি সঠিকভাবে তুলে ধরতে সচেষ্ট হননি। বিভিন্ন সমালোচকগণ বলেন, 'গীতগোবিন্দ' কাব্যে জীবাত্মার সাথে পরমাত্মার নিগূঢ় মিলনের বিষয় রাধাকৃষ্ণের প্রেমাচ্ছলে বর্ণিত হইয়াছে।" তারা প্রমথ চৌধুরীর মতের সাথে দ্বিমত পোষণ করে বলেন, রাধাকৃষ্ণের প্রণয়মূলক দু-চারটি ঘটনা নিয়ে জয়দেবের 'গীতগোবিন্দ' কাব্যটি রচিত হয়েছে। আরও বলেন এ কাব্যে আধ্যাত্মিকতার কোনো পরিচয় নেই। জয়দেব কাব্যে যেসব শব্দ ব্যবহার করেছেন তার সহজ ও প্রচলিত অর্থ অনুসারে যতটা বুঝা যায় তাতে মূল তত্ত্বের কোনো আবিষ্কার নেই। জয়দেবের কাব্যে প্রাবন্ধিক এটাই উল্লেখ করেছেন যে, রাধাকৃষ্ণ রক্তমাংসে গঠিত মানুষ এবং তাদের প্রেমকে স্ত্রী-পুরুষ ঘটিত প্রেম বলেই প্রাবন্ধিক উল্লেখ করেন।

প্রাবন্ধিক কাব্যটির কাব্যস্বরূপের ত্রুটির কারণে প্রমথ চৌধুরীর কাছে আকর্ষণীয় করে তুলতে ব্যর্থ হন। আর তিনি মনে করেন অনেকে কাব্যটি যথার্থভাবে পাঠ না করে কাব্যটির প্রতি বিমোহিত হন। আর এ কারণেই যে তার পরবর্তী বৈষ্ণর কবিদের গুণাবলি তার উপর আরোপ করা হয়। বৈষ্ণবকবিগণ রাধাকৃষ্ণের প্রেমলীলাকে তাদের কাব্যের উপজীব্য না করলেও হয়তো কারো কাছেই জয়দেবের 'গীতগোবিন্দ' কাব্যটি আবেদন সৃষ্টি করতে ব্যর্থ হতো। বাংলা সাহিত্যে বীরবল দ্বন্দ্বনামে যিনি আখ্যায়িত হয়েছিলেন তিনি হলেন প্রমথ চৌধুরী। নতুনত্ব চিন্তাশক্তি, নতুন মনন পদ্ধতি, জগৎ এবং জীবনকে স্বাতন্ত্র্যচিহ্নিত দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে সাহিত্যকে পরিপূর্ণতা দিতে সক্ষম হয়েছেন। তিনি বরাবর বই পড়ার প্রতি গুরুত্বারোপ করেছেন। কেননা বই পড়া ছাড়া সাহিত্যচর্চা করা সম্ভব নয়। তিনি মনে করেন "আমাদের শিক্ষার বর্তমান অবস্থায় লাইব্রেরি হচ্ছে এক রকম মনের হাসপাতাল।" ধর্মের চর্চা যেকোনো জায়গায় করা সম্ভব, নীতির চর্চা ঘরে বসে সম্ভব, দর্শনের চর্চা গুহাতে বসেকরা সম্ভব কিন্তু সাহিত্যের চর্চার জন্য লাইব্রেরি প্রয়োজন। তিনি আরও বলেছেন, লাইব্রেরির মধ্যেই আমাদের জাত মানুষ হবে।

আমরা যত বেশি লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠা করব, দেশের তত বেশি উন্নতি হবে। প্রমথ চৌধুরী আরও বলেছেন, "সুশিক্ষিত লোক মাত্রেই স্বশিক্ষিত।" কেননা স্বশিক্ষিত হবার জন্য নিজে নিজে বই পড়ার অভ্যাস গঠন করা অতীব জরুরি। কিন্তু আমাদের দেশে ঠিক-তার উল্টো বাধ্য না হলে কেউই বই পড়তে চায় না। যদি কেউ স্বেচ্ছায় বই পড়েন তাহলে পাঠদানকারীকে অন্যদের নিকট থেকে 'নিষ্কর্মা' উপাধিটি নিঃসন্দেহে পেতে হয়।

আমাদের মনের খোরাক মিটাতে হলে অবশ্য অবশ্যই বেশি করে বই পড়তে হবে। তাছাড়া প্রাবন্ধিক লাইব্রেরিকে হাসপাতালের উপরে স্থান দিয়েছেন। কেননা লাইব্রেরিতে গিয়ে মানুষ স্বেচ্ছায় বই পড়তে পারে এবং স্বশিক্ষিত হবার সুযোগ পায়। মানুষ তার রুচি অনুযায়ী জ্ঞানের রাজ্যে আপন মনে বিচরণ করতে পারে এবং এ কারণেই আমাদের প্রতিটি গ্রাম শহর প্রভৃতি জায়গায় লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠা করা প্রয়োজন। ললিতকুমার তার সতীর্থ একই যুগে একই বিদ্যালয়ে একই শিক্ষাপ্রাপ্ত লোকদের মধ্যে পরস্পরের মনোভাবে মিল থাকা স্বাভাবিক; তবে অনেক বিষয়ে প্রাবন্ধিক যে দ্বিমত করেন তারও প্রমাণ এ গ্রন্থে প্রকাশ করেছেন। ললিতবাবুর সাথে তার প্রধান পার্থক্য তিনি সাধুভাষার সপক্ষে এবং বিপক্ষে কি বলার আছে অথবা কি সচরাচর বলা হয়ে থাকে- সেই সকল কথা একত্র করে সাজিয়ে গুছিয়ে পাঠকের সামনে তুলে ধরেছেন। কিন্তু উভয়পক্ষের মতামত বিচার করে কোনোরূপ মীমাংসা করেননি। অপরপক্ষে, প্রাবন্ধিক বাংলা সাহিত্যের পক্ষে যা শ্রেয় তার জন্য তিনি স্পষ্ট করেছেন। সেই কারণে তিনি শুধু তার নিজের মতো প্রচার করেননি- সেই মতের অনুসারে লিখতেও চেষ্টা করেছেন। প্রাবন্ধিক মনে করেন কোনো জিনিসের এপিঠ-ওপিঠ দেখানোর কোনো বিশেষত্ব নেই যদি না কোনটা সোজা বা উল্টো তা যদি বলা না হয়। ললিতকুমার তার পুস্তিকায় দেখাতে চেষ্টা করেছেন সমস্যাটা কী বিপরীত দিকে প্রমথ চৌধুরী দেখাতে চেষ্টা করেছেন মীমাংসাটা কী। ললিতবাবু বলেছেন তার উদ্দেশ্য যতদূর সম্ভব নিরপেক্ষভাবে বিষয়টির আলোচনা করা। যদিও তার মনের ঝোঁক আসরে বঙ্গভাষার দিকে, তবু তিনি পদে পদে সে ঝোঁক সামলাতে চেষ্টা করেছেন। প্রমথ বাবু সে ঝোঁকটি সামলানোর মোটেই চেষ্টা করেননি। ললিতবাবু সাধুভাষা এবং চলিতভাষা উভয় ভাষারই সুবিধা অসুবিধা বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করে। বিষয়টিকে আলোচনার যোগ্য করে তুলেছেন। ললিতবাবু অনুসন্ধান করে সাধুভাষার সপক্ষে দুটি যুক্তি আবিষ্কার করেছেন। এক সাধুভাষা আর্টের অনুকুল। দুই: চলিত ভাষার অপেক্ষা হিন্দুস্তানি মারাঠি গুজরাটি প্রভৃতি ভিন্নজাতীয় লোকদের নিকট অধিক সহজবোধ্য। 

ললিতকুমার যুক্তি খণ্ডন করতে গিয়ে প্রমথ চৌধুরী বলেন, এ দেশে প্রায় দেখতে পাওয়া যায়, যুক্তি যখন কোনো দাঁড়াবার স্থান পায় না, তখন আট প্রভৃতি বড়ো বড়ো কথার অন্তরালে আশ্রয় গ্রহণ করেন। যে বিষয়ে স্পষ্ট কোনো ধারণা নেই, সে বিষয়ে বক্তব্য করা অনেকটা নিরাপদ, কেননা সে বক্তৃতা যে অন্তঃসারশূন্য, এ সত্যটি সহজে ধরা পড়ে না। তারই তথাকথিত সাধুভাষা সম্বন্ধে প্রাবন্ধিকের প্রধান আপত্তি এই যে, ওরূপ কৃত্রিম ভাষায় আর্টের কোনো স্থান নেই। রচনার লেখক নিজের মনোভাব ব্যক্ত করতে কৃতকার্য হন না। প্রাবন্ধিক দ্বিতীয় মতটি খন্ডন করতে গিয়ে বলেন,
"আমাদের দেশে ছোট ছেলেদের বিশ্বাস যে, বাংলা কথার পিছনে অনুস্বর জুড়ে দিলেই সংস্কৃত হয়; আর প্রাপ্তবয়স্ক লোকদের মতে যে, সংস্কৃত কথার অনুস্বর বিসর্গ ছেঁটে দিলেই বাংলা হয়। দুটো বিশ্বাসই সমান সত্য। বাঁদরের লেজ কেটে দিলেই কি মানুষ হয়?"

প্রাবন্ধিক আরো বলেন, ভারতবর্ষের বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন জাতি যে ভাষা ভাব আচার এবং আকার সম্বন্দ্বে নিজেদে বিশেষত্ব হারিয়ে এক জাতি হয়ে উঠবে এ আমা করা যায় না, আর কাঁঠালগাছ ক্রমে আমগাছ হয়ে উঠবে এ আশা করাও তাই। ললিতবাবু পণ্ডিতি বাংলার উপর বিশেষ নারাজ। প্রাবন্ধিক অবশ্য সে রকম রচনা পদ্ধতির পক্ষপাতী নই। "প্রবোধচন্দ্রিকা'র রচয়িতা মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালংকারে "পুরুষপরীক্ষা" গ্রন্থের ভাষা ললিতবাবু 'শব্দাড়ম্বর জড়িমা জড়িত ভাষা' মনে করলেও প্রমথ চৌধুরী সে গ্রন্থের ভাষাকে নধীর জলের ন্যায় স্বচ্ছ এবং স্রোতস্বতী বলে মনে করেন। বিংশ শতাব্দীর বাংলায় আধুনিকতার বাহন বাংলা সাময়িকী। প্রমথ চৌধুরীর সম্পাদনায় 'সবুজপত্র' প্রথম প্রকাশিত হয় ১৩২১ বঙ্গাব্দের (১৯১৪ সালে) ২৫ বৈশাখ। এ ধরনের একটি সাময়িকী প্রকাশ করার জন্য রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রমথ চৌধুরীকে উৎসাহ প্রদান করেছিলেন। এ সাময়িকীতে শুধু সবুজ রং-ই ব্যবহার করা হতো। নন্দলাল বসু অঙ্কিত একটি সবুজ তালপাতা এর প্রচ্ছদে ব্যবহৃত হতো। সবুজপত্রে কখনও কোনো বিজ্ঞাপন এবং ছবি প্রকাশিত হয়নি। প্রমথ চৌধুরী সাময়িকীটিকে বাণিজ্যিকভাবে আকর্ষণীয় রূপ প্রদানের জন্য কোনো চেষ্টা করেননি। বরং তিনি এর মান এবং আদর্শ সমুন্নত রাখার প্রতি অত্যন্ত সতর্ক ছিলেন। তাই সবুজপত্র সাধারণ পাঠক ও লেখকদের কাছে জনপ্রিয় হতে পারেনি। প্রথম পর্যায়ে এটি ১৩২৯ বঙ্গাব্দ (১৯২২ সাল) পর্যন্ত প্রকাশিত হয়। দ্বিতীয় পর্যায়ে সবুজপত্রের প্রকাশনা শুরু হয় ১৩৩২ বঙ্গাব্দ থেকে। সাময়িকীটি শেষ পর্যন্ত ১৩৩৪ বঙ্গাব্দে (১৯২৭ সালে) বন্ধ হয়ে যায়। স্বল্পায়ু সত্ত্বেও 'সবুজপত্র' প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর প্রজন্মের বাংলা ভাষা এবং সাহিত্য রীতি গঠনে একটি প্রধান শক্তি হিসেবে কাজ করে। প্রমথ চৌধুরী নতুন সাহিত্য রীতি প্রবর্তনের চেষ্টা হিসেবে কথ্য বাংলাকে অগ্রাধিকার দেন, যা 'বীরবলী' ভাষা (তার ছন্দনাম 'বীরবল' থেকে) রূপে পরিচিতি লাভ করে। তার প্রথম চেষ্টাটি ব্যর্থ হয়, কিন্তু দ্বিতীয়টি সফলতা লাভ করে। এরপর থেকে বাংলা সাহিত্যে কথ্য বাংলা প্রাধান্য লাভ করে। পরবর্তী সময়ে রবীন্দ্রনাথ লিখিত গদ্য এবং আধুনিক বাংলা সাহিত্য সবুজপত্রের সফলতা যথেষ্টভাবে প্রমাণ করে। সবুজপত্রের প্রথম সংখ্যায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত এবং সম্পাদকের নিজের লেখা সন্নিবেশিত হয়। এই ধারা শেষ পর্যন্ত বহাল ছিল। প্রথম ও শেষোক্ত ব্যক্তি ছিলেন সাময়িকীর প্রধান লেখক। কিন্তু উভয়েই একটি নতুন লেখকগোষ্ঠী সৃষ্টি করতে চেয়েছিলেন। প্রমথ চৌধুরীকে ঘিরে যেসব বুদ্ধিজীবী ছিলেন তাদের মধ্যে কয়েকজন পরবর্তী সময়ে বিশিষ্ট লেখকরূপে পরিচিতি লাভ করেন। ধূর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, অতুলচন্দ্র গুপ্ত, বরদাচরণ গুপ্ত, সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, কিরণশংকর রায় সবুজপত্রে লিখতেন। কান্তিচন্দ্র ঘোষ, অমিয় চক্রবর্তী এবং সুরেশ চক্রবর্তী কবিতা লিখতেন। সবুজপত্রে প্রকাশিত সকল লেখায় মুক্তচিন্তা, গণতন্ত্র, যুক্তি এবং ব্যক্তি স্বাধীনতা প্রকাশ পেয়েছে। কলকাতাস্থ পশ্চিমবঙ্গ বাংলা একাডেমি গ্রন্থাগারে সবুজপত্রের সকল সংখ্যা সংরক্ষিত আছে।

উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, বাংলা সাহিত্য জগতে সাধু ভাষা থেকে চলিত ভাষার রূপ দিয়েছেন। তিনি জন সাধারণের সুবিধার জন্য চলিত ভাষার প্রচলন করেন। সাধু ভাষা কৃত্রিম ভাষা একথা যেমন সত্য তেমনি প্রমথ চৌধুরী অনুসৃত গদ্যরীতিতে ব্যবহৃত চলিত রীতিটিও কৃত্রিম। যে ভাষা বাঙালি সন্তানের মুখে প্রতিনিয়ত উচ্চারিত হয় সেই ভাষা থেকে প্রমথ চৌধুরীর ভাষা অনেকখানি স্বতন্ত্র। সেই স্বাতন্ত্রের কারণ তাঁর মানসিক শক্তি, পরিমার্জনা এবং অতিসযত্ন লালিত এবং সেকারণে পরবর্তীদের মধ্যে তাঁর অনুসরণকারীদের সংখ্যা নগণ্য। তবে এভাবে বলা যায় যে, বাংলা ভাষায় বিশ শতাব্দীর প্রবাহে প্রমথ চৌধুরী একজন ভাষা শিল্পী, প্রাজ্য আলংকারিক। সর্বত্র তাঁর বক্তব্য স্বাতন্ত্র্য চিহ্নিত পরিশীলিত, শানিত, সুগভীর এবং শিল্পিত ভাষ্যে সমুজ্জ্বল।
আপনারঅদৃশ্যমন্তব্য
Cancel