বৃদ্ধির মুক্তির প্রবর্তক হিসেবে কাজী আবদুল ওদুদের মননশীল চিন্তার পরিচয় দাও

বৃদ্ধির মুক্তির প্রবর্তক হিসেবে কাজী আবদুল ওদুদের মননশীল চিন্তার পরিচয় দাও

'শ্বাশ্বত বঙ্গ' প্রবন্ধ গ্রন্থের আলোকে কাজী আবদুল ওদুদের মননশীল চিন্তা চেতনার পরিচয় দাও

কাজী আবদুল ওদুদ ছিলেন জাতিতে ভারতীয়, ভাষায় বাঙালি, ধর্মে মুসলমান, জীবনদর্শনে মানবিকবাদী, মতবাদে রামমোহন পন্থি, রাজনীতিতে গান্ধী ও নেহরূপন্থি, অর্থনৈতিক শ্রেণিবিচারে মধ্যবিত্ত ভদ্রলোক, সামাজিক ধ্যানধারণায় ভিক্টোরিয়ান লিবারুল। কোনোরূপ চরমপন্থায় তার বিশ্বাস ছিল না। 'শ্বাশ্বত বঙ্গ' প্রবন্ধ গ্রন্থে কাজী আবদুল ওদুদ মননশীল চিন্তাচেতনা, মুক্তবুদ্ধি ও প্রগতিশীল মানসিকতার পরিচয় দিয়েছেন।

ইউরোপীয় রেনেসাঁস দ্বারা কাজী আবদুল ওদুদের চিন্তা চেতনা আবর্তিত ছিল। 'মুসলিম সাহিত্য সমাজ' এর মাধ্যমে যে বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলনের সূচনা হয় তার ভাব-নির্মাতা ছিলেন কাজী আবদুল ওদুদ। আনুষ্ঠানিক ধর্মানুশীলনে নয় বরং ধর্মের মর্মানুসারী ওদুদ আদি ইসলামের পুনরুজ্জীবন চাননি। ইতিহাস, বিজ্ঞান, ধর্মতত্ত্ব, সমাজদর্শন এবং আধুনিক রাষ্ট্রদর্শন অনুসন্ধান করে তিনি বুদ্ধিবৃত্তিক যুক্তিবাদ ও উদার মানবতাবাদী ধারণায় ধর্ম- বর্ণ-নির্বিশেষে সকল মানুষের আর্থিক, সাংস্কৃতিক ও বৌদ্ধিক মুক্তি প্রত্যাশী ছিলেন।

কাজী আবদুল ওদুদের চিন্তাধারা ধর্মসংস্কারমুক্ত এবং সংস্কার উত্তীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গির পক্ষে তার অবস্থান। রামমোহনের কর্মনিষ্ঠ ভাবধারা তাকে প্রভাবিত করেছিল বলা যায়। কারণ তিনি বুদ্ধি ও যুক্তির তীক্ষ্ণতা দিয়ে জীবনকে বিবেচনা করতেন। আবেগের প্রেরণার চেয়ে তার ভাবধারার ছিল অধিক যুক্তিবাদী। আবেগের উষ্ণ প্রেরণা থেকে রামমোহন যেমন সমাজ, ধর্ম ও দেশের কাজে নিজেকে নিয়োজিত করেননি; কাজী আবদুল ওদুদও তেমনি। ওদুদের দৃষ্টিভঙ্গিও মুসলিম ও হিন্দু উভয় সমাজের বুদ্ধিবৃত্তিক মিলন নির্ভর। রবীন্দ্রনাথ, গ্যেটে, কামাল আতাতুর্ক, রোমা রোলাঁ, শেখ সাদী, হযরত মুহম্মদ (স) এবং মহাত্মা গান্দী প্রমুখ মনীষীর দৃষ্টিভঙ্গির দ্বারা কাজী আবদুল ওদুদের অন্তর্লোক আলোকিত ছিল। তাই তার ধর্মীয়, সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাহিত্যিক ভাবধারার মধ্যে একটি উদার, মানবিক, যৌক্তিক, অসাম্প্রদায়িক এবং বৈশ্বিক বোধ অভিব্যক্ত হয়েছে।

সব বিদ্যারই শিক্ষক থাকে, চিন্তার থাকে মুর্শিদ, দীক্ষার থাকে গুরু। পরিবেশে বীজ না থাকলে কোনো চিন্তাই উদ্রেক হয় না; আগুনের যেমন নিরবলম্ব কোনো রূপ নেই, তেমনি অকারণ চিন্তারও স্থিতি নেই। কাজী আবদুল ওদুদের চিন্তার আগ্রহ জাগিয়েছেন যে মুর্শিদ, তিনি বাংলার রামমোহন, সমাধানের দিশা মিলেছে যার কাছে তিনি হযরত মুহম্মদ আর পদ্ধতি পেয়েছেন গ্যেটে থাকে। কাজী ওদুদ বীরপূজায় আসক্ত ছিলেন, কারলাইল বর্ণিত সেই 'হিরোওরশিপ'। মহৎ ব্যক্তিত্বে মুগ্ধ ওদুদ তিন ব্যক্তিত্বকে জীবনে ধ্রুবতারার মতো অনুসরণ করেছেন দিশার রূপে। ব্যক্তিত্ব তাকে চুম্বকের মতো আকর্ষণ করতো। চোখে দেখা তিনজন গুণী মানুষ রবীন্দ্রনাথ, নজরুল ইসলাম ও সুভাসচন্দ্র বসু তার শ্রদ্ধেয় ছিলেন কবিদ্বয় সম্বন্দ্বে বই লিখেছেন, আর কবি না হয়েও নেতাজীর প্রশক্তি রচনা করেছেন ছন্দে। আর ধ্যানে পাওয়া তিনজন মহাপুরুষ তার সারাজীবন সবিস্ময় শ্রদ্ধায় অভিভূত রেখেছিলেন। একজন হচ্ছেন পৃথিবীর মহত্তম মহামানব হযরত মুহম্মদ, অপরজন স্বদেশের উনিশ শতকী মহত্তম পুরুষ রামমোহন এবং অন্যজন হলেন আঠারো-উনিশ শতকী মহত্তম মানুষ গ্যেটে। এই তিনজনের ব্যক্তিত্বের ও কৃতির অনুধ্যানে তিনি উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন। উক্ত তিনজনের ব্যক্তিত্ব, কৃতি ও কীর্তির ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ সংবলিত তিনখানি গ্রন্থ রচনা করে তার গভীর শ্রদ্ধা, গুণগ্রাহিতা ও উপলব্ধি ব্যক্ত করেছেন।

কাজী আবদুল ওদুদের শাশ্বত বঙ্গ, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল ইসলাম, শরৎচন্দ্র ও তারপর, প্রভৃতি প্রবন্ধ ছাড়াও তার রুচিবোধ, প্রজ্ঞা প্রবণতা, জীবনদৃষ্টি ও সমাজচিন্তা অভিব্যক্তি পেয়েছে। উল্লেখিত এসব প্রবন্ধ ছাড়াও ওদুদ সৃষ্ট বিভিন্ন গল্প উপন্যাসেও তার সাহিত্যবোধ, জীবনচেতনা ও কল্যাণকামিতা সুস্পষ্ট। তিন অসামান্য ব্যক্তিত্ব তার মন-মনীষা প্রভাবিত করেছিল। রামমোহনের সংস্কারমুক্তি ও যুক্তিপ্রিয়তা, গ্যেটের শ্রেয়ঃবোধ ও মানবতা আর মহামানব মুহম্মদের সামাজিক ও আত্মিক জীবনের অখন্ডতাবোধ অর্থাৎ বহির্জীবন ও অন্তর্জীবনের অভিন্ন সত্তার উপলব্ধি প্রসূত সমাজচিন্তা তাকে গভীরভাবে প্রভাবিত ও প্রলুব্ধ করেছিল। এমনি জীবনদৃষ্টি নিয়ে তিনি জগৎ ও জীবনকে প্রত্যক্ষ করতে প্রয়াসী ছিলেন। অন্যকেও সে দৃষ্টিদানের জন্য আগ্রহ ছিল তার। উপর্যুক্ত আলোচনা পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, কাজী আবদুল ওদুদের অনুধোয় জগৎ, জীবন ও সমাজ সুন্দর ছিল তাতে সন্দেহ নেই। রোমারোঁলা, কামাল আতাতুর্ক, জামালুদ্দীন আফগানী প্রমুখও তাকে নানাভাবে অনুপ্রাণিত করেছেন। কিন্তু এমন আদর্শ নিষ্ঠ মানুষের সুন্দর স্বপ্ন, সুচিন্তা ও সদিচ্ছা ফলপ্রসূ হওয়ার ছিল না।
আপনারঅদৃশ্যমন্তব্য
Cancel