'সংস্কৃতির কথা' অবলম্বনে কাজী আবদুল ওদুদের সংস্কৃতিভাবনা তুলে ধর
কাজী আবদুল ওদুদ একজন আদর্শ সংস্কৃতিবান ও পরিশ্রুত বুচির মানুষ ছিলেন। তিনি ছিলেন বিদ্বান, বুদ্ধিমান, বিজ্ঞ, বিবেকবান, সত্যসন্ধানী এবং সত্যানুরাগী। তার অন্যতম প্রবন্ধ 'সংস্কৃতির কথা'। যে প্রবন্ধে তিনি তুলে ধরেছেন সামাজিক উৎকর্ষ লাভ সংস্কৃতির মূল কথা এবং সংস্কৃতি বিশ্বসামাজিক ও রাষ্ট্রিক। সংস্কৃতি বলতে তিনি একটি রাষ্ট্রের সকল মানুষের চিন্তা, কর্ম প্রভৃতিকে বুঝিয়েছেন।
আঠারো শতকে ইউরোপে নানা ধরনের বিপ্লব সংঘটিত হয়। এসব বিপ্লবের ফলে উনিশ শতকে ইউরোপে শুরু হয় নতুন সংগঠনের কাল। সেই থেকে অতীতের ধর্মের স্থান দখল করে সংস্কৃতি। সংস্কৃতি বলতে বুঝায় বিশেষ এক সমন্বয়। সব ধরনের জ্ঞান ও উৎকর্ষ সংস্কৃতির অন্তর্ভুক্ত। সংস্কৃতির সংজ্ঞায় বলা হয়, সংস্কৃতি হচ্ছে অতীতের শ্রেষ্ঠ ভাবসম্পদের সমাহার। প্রথমে এর প্রবণতা হয় ব্যক্তিতান্ত্রিকতার দিকে-ব্যক্তিত্বের উৎকর্ষই হয় এর প্রধান লক্ষ্য। ইউরোপে সঙ্ঘবদ্ধ জীবন অনেক বেশি সক্রিয়। তাই অচিরেই ব্যক্তিতান্ত্রিকতার মোড় ফেরে সামাজিকতার দিকে। ভারতবর্ষে সংস্কৃতির ব্যক্তিতান্ত্রিক প্রবণতা অনেক। তবে গণতান্ত্রিক শাসন রীতির প্রবর্তন ও সাম্প্রদায়িক বিরোধ তীব্র হওয়ায় আমাদের সাংস্কৃতিক চেতনায় সমাজবোধ একটা বড় জায়গা করে নিয়েছে। প্রবন্ধের শুরুতেই বলা হয়েছে, "ইয়োরোপের উনবিংশ শতাব্দীর ঢেউ ভারতবর্ষে যে এসে লাগবে বিংশ শতাব্দীতে এতে আশ্চর্য হবার কিছু নেই।"
ভারতবর্ষে সাংস্কৃতিক চিন্তার ইতিহাসে বঙ্কিমচন্দ্র ও ইকবাল বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এরা দুজনেই চেয়েছেন প্রাচীন ধর্মের নতুন ব্যাখ্যা দিতে। সঙ্গে সঙ্গে কীভাবে শক্তিশালী রাষ্ট্র গঠন করা যায় তাও ব্যক্ত করেছেন। তাদের জনপ্রিয়তার মূল চাবিকাঠি হলো তারা সনাতন স্থিতিশীলতার সঙ্গে কিছু গতিশীলতা মিশিয়েছেন। স্থিতিশীলতা আর গতিশীলতা এই যে অদ্ভুত মিশ্রণ আমাদের দেশের চিন্তায় ঘটেছে আমাদের একালের সংস্কৃতিগত চিন্তায় এই একটি গোড়ার কথা।
সংস্কৃতির মূল কথা হলো সামাজিক উৎকর্ষ সাধন করা। একদিকে বিশ্বমানব সমাজ অন্যদিকে, বিশেষ বিশেষ দেশগত বা রাষ্ট্রগতর সমাজ হওয়ার কারণে সংস্কৃতি মূলত বিশ্ব সামাজিক ও রাষ্ট্রিক। যে চিন্তা জগতের অনেকের মনে অনুরণন জাগায় না এবং যার রাষ্ট্রিক সার্থকতা কম তা বাস্তবিকই স্বল্পমূল্য বা মূল্যহীন-হোক না তা অন্যভাবে যত অসাধারণ।
হিন্দু সংস্কৃতি, মুসলিম সংস্কৃতি, আর্য সংস্কৃতি, সেমীয় সংস্কৃতি ইত্যাদিতে যে সুচিন্তা কার্যকরী হচ্ছে না তা সহজেই বুঝা যায়। হিন্দু ও মুসলমানের রাষ্ট্রিক জীবন সম্মিলিত নয়। কিন্তু সাংস্কৃতিক জীবন ভিন্ন হওয়ার কারণে সাংস্কৃতিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রিক উৎকর্ষ বাধা প্রাপ্ত হয়। হিন্দু সংস্কৃতি, মুসলিম সংস্কৃতি এসব চিন্তা কিছু পরিমাণে কার্যকরী হতেও পারে যদি হিন্দু ও মুসলমানের রাষ্ট্রিক জীবন স্বতন্ত্র হয়।
সংস্কৃতি সম্পর্কে বিশ্বজনীনতার প্রসঙ্গ তুলে ধরা হয়েছে। বিভিন্ন দেশের মানুষ পরস্পরের অত্যন্ত কাছাকাছি এসেছে বলে চিন্তার বিশ্বজনীনতা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। সংস্কৃতি মানুষের সৌখিন পোশাক পরিচ্ছেদ নয়, তা হলো জীবন যুদ্ধের অস্ত্র। কাজেই সংস্কৃতির ক্ষেত্রে প্রাচীন চিন্তার দোহাই একালে বাস্তবিকই অচল। মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ, পাঠান, আরব ইত্যাদি বিচিত্র উপাদানে এ সমাজ গঠিত। আশরাফ ও আতরাফ দুই শ্রেণির মধ্যে সামাজিক আদানপ্রদান ছিল না। যেমনি ছিল না হিন্দুদের জাতিভেদের মধ্যে। চলমান এ পরিস্থিতির কারণে বাংলার মানুষের ক্ষুদ্র সংহতি জীবনই মুখ্যত হয়ে পড়েছে। বৃহত্তর দেশ সম্পর্কে চেতনা খুব কমই অনুভূত হয়েছে। 'যত মত, তত মতো' তত্ত্বের সূত্রে ভারতবর্ষের লোকদের জীবন গ্রথিত হয়েছিল তাতে কিছু শান্তি হয়ত ভারতীয় সমাজজীবনে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল; কিন্তু যার অভাব ঘটেছিল তার নাম সচেতনতা।
বাংলায় মুসলমানদের আর্বিভাব ঘটে দ্বাদশ শতাব্দীতে। ইসলাম বাংলায় প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর মুসলমান সমাজ সম্ভ্রান্ত ও সাধারণ শ্রেণিতে বিভক্ত হয়ে যায়। যারা সম্ভ্রান্ত তারা প্রধানত অনুবর্তী ছিলেন ইসলামি সংস্কৃতি বলতে যা বুঝায় তার। আর সাধারণ শ্রেণি চলত তাদের পূর্ব পুরুষদের ধারায়। এমনভাবে কয়েক বছর কাটার পর বাংলা ইউরোপের সংস্পর্শে আসে। ইউরোপের সংস্পর্শে আসায় প্রথমে দেশের যা ফল লাভ হলো এক হিসাবে তা বহুমূল্য, কেননা হিন্দু-মুসলমান দেশের সব সমাজেই আত্ম- অন্বেষণ সক্রিয় হলো এবং দেশের বিভিন্ন কেন্দ্রে অনেক মহিমাময় ব্যক্তির আবির্ভাব হলো।
সংস্কৃতির একটি সংজ্ঞা হলো সুন্দরের সাধনা। যাদের ব্যক্তিতান্ত্রিক প্রবণতা বেশি তারাও এই সংজ্ঞায় খুশি হবে। কিন্তু সুন্দর তো শুধু মোহকর নয়, সুন্দর বিশেষভাবে সত্যাশ্রয়ী-জগৎ ও জীবনের সঙ্গে তার যোগ যেমন দৃঢ় তেমনি তার গতি সার্থকতা লাভের দিকে। সত্যাশ্রয়িতা, অর্থাৎ সত্য উপলব্ধির চেষ্টা আর সার্থক হওয়ার আকাঙ্ক্ষা, যাদের অন্তরের ধর্ম নয় তারা জ্ঞানীও নন কর্মীও নন।
বাংলার মুসলমানের সংস্কৃতির দিকে তাকালে দেখা যাবে মানব দৈন্যে মুসলমান জর্জরিত, আর্থিক দৈন্যের চেয়ে ভাবের দৈন্যই বেশি, দৈন্য সংকল্পেরও। তবে বর্তমানে এ সংস্কৃতি পরিবর্তন হচ্ছে জগতের বিভিন্ন দেশের বা বিভিন্ন সমাজের মানুষের পারস্পরিক দায়বোধ বেড়ে যাওয়ার কারণে। দেশের উন্নতি করতে চাইলে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের সাথে সম্মিলিত হওয়া দরকার। এ সম্মিলনে বৈচিত্র্য থাকবে। লক্ষ রাখতে হবে যে, বৈচিত্র্য যেন একত্বকে বিপন্ন না করে।
অসার্থক সংস্কৃতি চিন্তার স্তর থেকে সার্থক সংস্কৃতি চিন্তার স্তরে উপনীত করতে হলে প্রাবন্ধিক কিছু ধাপের কথা ব্যক্ত করেন, যা অতিক্রম করতে হবে।
যেমন:
১. দেশে অভুক্ত ও কর্মহীন কেউ থাকবে না।
২. হিন্দু-মুসলমানের পোশাক ও নামের ব্যবধান থাকবে না অথবা অস্বীকার করা যাবে না।
৩. সামাজিক আদানপ্রদান বিবাহ আদি সমেত সর্বত্র সহজ হবে।
৪. আইন সব দেশের জন্য এক হবে।
উপর্যুক্ত আলোচনা পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, মানুষের বিচিত্র সংস্কৃতির সেই প্রাণশক্তি আজ চিন্তার ক্ষেত্রে নাম পেয়েছে বৈজ্ঞানিকতা ও মানবহিত, আর কর্মের ক্ষেত্রে নাম পেয়েছে সুব্যবস্থিত রাষ্ট্রজীবন ও প্রতিষ্ঠিত হবে সেই বৈজ্ঞানিকতা মানব হিত ও সুব্যবস্থিত রাষ্ট্রের ভিত্তির ওপরেই।
প্রশ্নটি অন্য যেভাবে আসতে পারে