কাজী আবদুল ওদুদের দৃষ্টিতে নজরুলের প্রতিভার স্বরূপ আলোচনা কর
কাজী আবদুল ওদুদের দৃষ্টিতে নজরুল ইসলামের কবিসত্তার স্বরূপ বিশ্লেষণ কর।
বিশ শতকের বাঙালি-সংস্কৃতি ও বাংলা সাহিত্যে প্রগতশীল চিন্তাচর্চার অন্যতম অগ্রপথিক ছিলেন কাজী আবদুল ওদুদ। ইউরোপীয় রেনেসাঁস তার চিন্তাচেতনায় আবর্তিত হচ্ছিল। কাজী আবুদল ওদুদের অন্যতম প্রবন্ধ নজরুল ইসলাম। এ প্রবন্ধে কাজী আবদুল ওদুদ নজরুল ইসলামের কবিসত্তার স্বরূপ বিশ্লেষণ করেছেন।
বাংলার বিদ্রোহী কবি অভিধায় অভিহিত কবি কাজী নজরুল ইসলামের সাহিত্যিক জীবনকে চারটি অধ্যায়ে বা ভাগে ভাগ করেছেন প্রাবন্ধিক কাজী আবদুল ওদুদ। কাজী নজরুলের সাহিত্যিক জীবনের সূচনা থেকে 'বিদ্রোহী' প্রকাশের পূর্ব পর্যন্ত প্রথম স্তর, 'বিদ্রোহী' প্রকাশের পর থেকে তার রাজনৈতিক জীবনের অবসান - পর্যন্ত দ্বিতীয় স্তর, তার সংগীত রচনার বিশেষ করে গজল রচনার যুগ তৃতীয় স্তর, চতুর্থ স্তর তার যোগী জীবন।
প্রথম স্তরে নজরুলের কবিতায় পরিলক্ষিত হয় নবীনতা বা উদ্দামতা আর ছন্দ সামর্থ্যের প্রতি বাংলার সাহিত্যিকদের দৃষ্টি আকর্ষণের সফল ও সার্থক প্রয়াস। 'বিদ্রোহী' প্রকাশের পূর্বেই 'শাত-ইল-আরব', 'মহররম', 'কোরবানী' প্রভৃতি কবিতায় অনুভূত হয়েছিল মুসলমান সমাজের স্থির ও গতিহীন জীবনের প্রতি বিতৃষ্ণা ও নতুন জীবন আরম্ভে বলিষ্ঠ প্রত্যয়। এ যুগের একটি বিশিষ্ট রচনা 'বাঁধন-হারা' পত্রোপন্যাস। এতে কবি তার তরুণ জীবনের কিছু পরিমাণ চিত্র তুলে ধরেছেন। রবীন্দ্রনাথ, সতেন্দ্রনাথ ছিলেন তার প্রিয় কবি এবং ইরানি কবি হাফিজ প্রিয় ছিল প্রেমের উন্মাদনার জন্য। আর এক শ্রেণির ভাবুকদের প্রতিও কবির গভীর শ্রদ্ধা ছিল তারা বাংলার সন্ত্রাসবাদী দল।
স্থির, গতিহীন জীবনের প্রতি বিতৃষ্ণা এবং নতুন জীবনারম্ভের বলিষ্ঠ প্রত্যয় দেখা যায় এ স্তরে। এ অর্থে ওদুদ বিদ্রোহী রচনার পর্বের নজরুলকে চিহ্নিত করেছেন খেলাফতের যুগের প্রতিনিধি স্থানীয় কবি। কবির ভাববিলাস, অভিমান, ব্যর্থ প্রেমের গভীরতা, বেদনা থেকেই উৎসারিত ছিল দায়িত্বহীন ভবঘুরে জীবন।
বিদ্রোহী পর্বে নজরুল মানসে হঠাৎ একটি বৃহৎ চেতনার আবির্ভাব ঘটে। 'বিদ্রোহী' যুগের অধিকাংশ কবিতায় সাম্যবাদের প্রভাবে নজরুলের চেতনায় ছিল দুস্থ, বঞ্চিত অর্থাৎ অবহেলিত মানুষের প্রতি অনুরাগ। এজন্য প্রাবন্ধিক বলেছেন, "... এর জন্যই নজরুলকে এ যুগের একজন অসাধারণ কবি ভাবা কঠিন, কিন্তু এ যুগের একজন অসাধারণ ব্যক্তি তিনি অবিসংবাদিত রূপে।"
রবীন্দ্রনাথের যেমন 'নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ' অথবা 'এবার ফিরও মোরে' নজরুলের তেমনি 'বিদ্রোহী'। নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ অথবা 'এবার ফিরাও মোরে' রবীন্দ্রনাথের কবিচিত্তে যত বড় দোলাই দিক, এসবের প্রভাবে তার জীবনের সাধারণ ধারায় যে পরিবর্তন এসেছে তা লক্ষ্যযোগ্য হয়নি দীর্ঘদিন। নজরুল ইসলামও 'বিদ্রোহী' রচনার পরে যে একেবারে বদলে গিয়েছিলেন তা ঠিক নয়; 'বিদ্রোহী কবিতায়ও দেখা যায়, একদিকে নজরুল যেমন নিজের ভিতরে অনুভব করেছেন সাইক্লোনের শক্তি অন্যদিকে তেমনি তিনি মুগ্ধ হয়েছেন 'চপল মেয়ের কাঁকন চুড়ির কনকনে'র ছলনায়। তবে বিদ্রোহীর আকর্ষণ কবিকে বাস্তবিকই ঘর ছাড়া করেছিল। সেই দিনে তার সাম্যবাদ প্রচার আর বেপরোয়া শিকল ভাঙার গানের কথা যাদের মনে আছে তারা স্মরণ করতে পারেন প্রচন্ড ধূমকেতুর মতো কী এক ভীষণ মনোহর জীবন কবির ভিতরে সূচিত হয়েছিল। নজরুল একজন যুগ প্রবর্তক কবি। নজরুলের কবিতায় প্রকাশ পেয়েছে বাংলার দার্শনিক আবহাওয়ার চিন্তালেশহীন ভাস্বর ললাট চির তারুণ্য। এই দ্বিধাহীন দুর্মর তারুণ্যই বাংলা সাহিত্য নজরুল প্রতিভার চিরগৌরবময় দান।
'বিদ্রোহী' কবিতাতে কবি তার নিজের শক্তি সম্ভাবনা সম্পর্কে বিশেষভাবে সচেতন হয়ে ওঠেন। সেই চেতনার দুটি ধারা এক দিকে তার অন্তরে জাগে অপরিসীম আত্মপ্রত্যয়, অন্যদিকে তিনি নিজেকে জ্ঞান করেন জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে দুঃস্থ মানবতার অগ্রনায়ক। তৃতীয় যুগে প্রেম সংগীত রচনার সাথে সাথে তিনি ইসলামী, শ্যামা, বৈষ্ণব সংগীত রচনা করেছেন। শ্যামা সংগীত রচনায় তিনি বিশেষ দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। সংগীতের মধ্য দিয়েই তিনি বাংলার জনসাধারণের চিত্তে প্রবেশ করেছেন। ইসলামি সংগীতের অধিকাংশ প্রশস্তিমূলক। এক ধরনের সুফিদের উৎকট গুরুভক্তির রূপ পেয়েছে তার গানে। তবে নজরুলের বিশেষ সাফল্য তার শ্যামা সংগীতে। শ্যামা সংগীতে রূপ-অরূপের বর্ণনা একই সাথে করতে তিনি সমর্থ হয়েছেন। বৈষ্ণব পদ কর্তারা বৈষ্ণব সংগীতে যে সাফল্য অর্জন করেছেন ততটা না হলেও নজরুলের বৈষ্ণব সংগীত অপূর্ব মাধুর্যমণ্ডিত হয়ে দেখা দিয়েছে। নজরুল একদিকে যেমন শ্যামা সংগীত লিখেছেন, অন্যদিকে ইসলামি কবিতা ও গান লিখেছেন। নজরুল বাঙালি মুসলমানের প্রিয় হয়েছেন তার ইসলামি কবিতা ও ইসলামি গান দিয়ে। তার প্রভাবে যে সমাজে নব উদ্দীপনা এসেছে, এ কথাও সর্ববাদিসম্মত।
নজরুলকে বিদ্রোহী রূপে দেখা, সাম্যবাদী রূপে দেখা, হিন্দু- মুসলমানের সমন্বয়কারী রূপে দেখা অসার্থক নয় বরং এক হিসেবে যথেষ্ট সার্থক এজন্য যে, এমনি করে দেখে কবিকে আরও নিকটে পাওয়া যায়। নজরুল যে প্রেম সংগীত রচনা করেছেন তা সহজেই চোখে পড়ে তার 'বাঁধন-হারা' পত্রোপন্যাসে; যেখানে কবির প্রথম জীবনের যে ব্যর্থ প্রেমের ছবি অঙ্কন করেছেন এবং যা তার সারা জীবনের ধুয়া। তার প্রেম যেমন রাধিকার তণু-মন-ধন-জীবন- যৌবন তব পায়ে সমর্পণের প্রেম নয়; তাঁর বিরহও তেমনি রাধিকার বুক-ভাঙা বিরহ নয়।
প্রাবন্ধিক নজরুলের রচনায় তত্ত্ব, ধর্ম প্রভৃতির সাথে ব্যক্তি নজরুলের মনোভাব তুলে ধরেছেন। বিদ্রোহী কবিতার আছে কবির ব্যক্তিসত্তার জাগরণ এবং এর সঙ্গে সমাজের মানুষের সমষ্টিক প্রতিনিধি হয়ে উঠেছে। তাই নজরুল রচনা অসামান্য হয়ে উঠেছে। ইসলামি ঐতিহ্য, আদর্শকে তিনি নিজের মতো করে কবিতায় ব্যবহার করেছেন। গজল, শ্যামা সংগীতের সময় নজরুল Misticism দ্বারা বেশি প্রভাবিত হয়েছে এবং সেখানে তিনি আত্মকেন্দ্রিক পর্যায়ে প্রেমবিষয়ক কবিতা লিখেছেন।
রোমান্টিকতা, প্রকৃতির মধ্যে বিলীন হওয়ার আকৃতি প্রকাশ পেয়েছে। 'বাধন-হারা' পত্রোপন্যাসে তার সমগ্র মানস ওঠে এসেছে। নজরুল বার বার প্রতীকের ভিন্নধর্মী ব্যবহার করেছেন। কারণ কবি নিঃসঙ্গ ব্যক্তি নন- কোনো সমাজের বা জাতির তিনি প্রতিনিধি। নজরুল এ যুগের বাঙালি জাতির প্রতিনিধিত্ব করেছেন প্রধানত জড়তার বিরুদ্ধে বারবার সংগ্রাম ঘোষণা করেও নির্যাতিত জনসাধারণের পক্ষ সমর্থন করে।
উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, কাজী আবদুল ওদুদের মতো মনীষীও নজরুল ইসলামকে প্রতীক পূজারি বলতে কসুর করেননি। নজরুলের এ প্রতীক প্রগতি খানিকটা ইয়োরোপীয় রেনেসাঁসের প্রতীক প্রীতির মতোই। নজরুল ইসলাম তার ইসলামি কবিতা ও ইসলামি গান দিয়ে বাঙালি সমাজে নব উদ্দীপনা জাগিয়েছেন এবং এরই সঙ্গে হিন্দু দেবদেবীর মহিমার গানও গেয়েছেন।