'কাজী আবদুল ওদুদ ব্যক্তি ও নবজাগরণের আন্তঃসম্পর্ক নির্ধারণ করতে চেয়েছেন।'-'বাংলার জাগরণ' প্রবন্ধ অবলম্বনে মন্তব্যটির সত্যতা বিচার কর

উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, 'বাংলার জাগরণ' প্রবন্ধে অবিভক্ত ভারতের বাংলা অঞ্চলে উনবিংশ ও বিংশ শতকে সমাজ সংস্কার আন্দোলনের কথা উল্লেখ..
'বাংলার জাগরণ' প্রবন্ধের উপজীব্য বিষয় ব্যাখ্যা কর।

'বাংলার জাগরণ' প্রবন্ধের উপজীব্য বিষয় ব্যাখ্যা কর

কাজী আবদুল ওদুদ বিশ শতকের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বাঙালি সমাজচিন্তাবিদ। মনন ঋদ্ধ প্রাবন্ধিক হিসেবে বাংলার মুসলমান সমাজের সংস্কৃতি বিকাশের ইতিহাসে তিনি অনুসরণীয় চিন্তানায়ক। বুদ্ধিরমুক্তি আন্দোলনে, তাত্ত্বিক ও কর্মীপুরুষ হিসেবে অবদানের জন্য তিনি অন্যতম পথিকৃৎ ব্যক্তিত্ব। কাজী আবদুল ওদুদের অন্যতম প্রবন্ধ 'বাংলার জাগরণ' যেখানে কাজী আবদুল ওদুদের মুক্তবুদ্ধির পরিচয় পাওয়ার সাথে তার মননশীলত চিন্তাচেতনার পরিচয় পাওয়া যায় এবং ভারতের ক্ষেত্রে উনবিংশ শতাব্দীর শেষার্ধে যে জ্ঞানালৌকিক মনীষীর উন্মেষ বাংলার রেনেসাঁয় প্রত্যক্ষ হয়।

বাংলার জাগরণ বলতে বুঝায় ব্রিটিশ রাজত্বের সময় অবিভক্ত ভারতের বাংলা অঞ্চলে উনবিংশ ও বিংশ শতকে সমাজ সংস্কার আন্দোলনের জোয়ার ও বহু কৃতি মনীষীর আবির্ভাবকে। মূলত রাজা রামমোহন রায়ের সময় এ নবজাগরণের শুরু এবং এর শেষ ধরা হয় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সময়ে, যদিও এর পরে বহু জ্ঞানী-গুণী মানুষ এ সৃজনশীলতা ও শিক্ষাদীক্ষার জোয়ারের বিভিন্ন ধারার ধারক ও বাহক হিসেবে পরিচিত হয়েছেন। এ প্রবন্ধে তুলে ধরা হয়েছে উনবিংশ শতকের বাংলা ছিল সমাজ সংস্কারক, ধর্মীয় দর্শনচিন্তা, সাহিত্য, সাংবাদিকতা, দেশপ্রেম ও বিজ্ঞানের পথিকৃৎদের এক অন্যন্য সমাহার; যা মধ্যযুগের অন্ধত্ব ঘুচিয়ে এদেশে আধুনিক যুগের সূচনা করে। নবজাগরণ ভাবাপন্ন ব্যক্তিবর্গের মধ্যে রামমোহন রায়, ডিরোজিও ও তার বিপ্লবী শিষ্যবৃন্দ, দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ও তার অনুসারীগণ, অক্ষয়কুমার দত্ত, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, মাইকেল মধুসূদন দত্ত, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, স্বামী বিবেকানন্দ প্রমুখ। রেনেসাঁর এ নিবেদিত মনীষীগণ যে পাশ্চাত্য চিন্তাধারায় উজ্জীবিত হয়েছিলেন। তা ছিল যুক্তিবাদ, মানবতাবাদ, উপযোগবাদ, বিজ্ঞানবাদ, দৃষ্টবাদ, ডারউইনবাদ, সমাজবাদ ও জাতীয়তাবাদ।

'বাংলার জাগরণ' দুই ধারায় প্রসার লাভ করে। যথা: ১. ঐ সময়ে বহুসংখ্যক সংবাদপত্র ও সাময়িকী প্রকাশিত হয় এবং ২. বহু সমিতি, সংগঠন ও সমাজ প্রতিষ্ঠিত হয়। রামমোহন রায় একাধারে সংস্কৃত, আরবি, ফার্সি ভাষায় সুপণ্ডিত এবং পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত ব্যক্তি ছিলেন। তিনি ধর্মীয় গোঁড়ামির প্রতিবাদে তুহফাত-উল-মুত্তয়াহহিদিন (একেশ্বরবাদীদের উপহার) নামে এক যুক্তিবাদী পুস্তিকা প্রকাশ করেন। পরবর্তী সময়ে তিনি সেমেটিক একেশ্বরবাদের ধারায় উপযোগবাদের সাথে যুক্তিবাদ সংযুক্ত এবং সামাজিক অন্যায় ও বুদ্ধিবৃত্তিক কূপমণ্ডুকতা দূর করার লক্ষ্যে একটি কার্যক্রম গ্রহণ করেন। হিন্দু ও খ্রিস্টানদের সঙ্গে দীর্ঘ পনেরো বছরের (১৮১৫-'৩০) এক বিতর্কে তিনি তার ব্রাহ্ম একেশ্বরবাদ প্রতিষ্ঠিত করতে এবং বাহ্যত বহু ঈশ্বরবাদ ও ত্রিত্ববাদকে পরাভূত করেন। তিনি সামাজিক বিচার, বিশেষ করে হিন্দু নারী মুক্তির জন্য সুদীর্ঘ শতাব্দীকালের সূচনা করেন। রামমোহন সংবাদপত্রের স্বাধীনতার সংগ্রাম করেন এবং পাশ্চাত্য শিক্ষাক্রমের ভিত্তিতে ধর্মনিরপেক্ষ ও বিজ্ঞানবিষয়ক শিক্ষানীতি প্রবর্তনের সুপারিশ করেন।

মুক্তচিন্তার অধিকারী হেনরি ডিরোজিও হিন্দু কলেজের ইতিহাস ও সাহিত্য পড়াতেন। তিনি তার প্রায় ডজনখানেক অনুসারীকে মুক্ত ও স্বাধীন চিন্তানুশীলনে অনুপ্রাণিত করেন। তারা সকলে ইয়ংবেঙ্গল নামে পরিচিতি লাভ করেন। ইয়ং বেঙ্গলদের আক্রমণের প্রধান লক্ষ্য ছিল সনাতন হিন্দুধর্মীয় মতবাদের আসার চিন্তাধারা। ডিরোজিওর সম্পর্কে প্রবন্ধে বলা হয়েছে, "রামমোহন ইয়োরোপীয় জ্ঞান-বিজ্ঞানের চমৎকারিত্বের ইঙ্গিত দিয়েছিলেন মাত্র, কিন্তু সেই জ্ঞানের স্বাদ বাঙালি প্রকৃত প্রস্তাবে পায় ডিরোজিওর কাছ থেকে।" 

ব্রাহ্মসমাজের অন্যতম নেতা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ও বিজ্ঞানপন্থি অক্ষয়কুমার দত্তের কথা ব্যক্ত করা হয়েছে। দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর রামমোহনের আধ্যাত্মিকতার উত্তরাধিকারী হন। আর দত্ত অনুপ্রাণিত হন রামমোহনের যুক্তিবাদী বিজ্ঞান মনষ্কতায়। অক্ষয়কুমার দত্ত ব্রাহ্মবাদকে অতিবর্তী ঈশ্বরবাদে রূপান্তরিত এবং বিজ্ঞানভিত্তিক জ্ঞানান্বেষাকে ঐশ্বরিক প্রত্যাদেশের তথা অলৌকিকতার স্থলবর্তী করতে চেয়েছিলেন। শুধু প্রার্থনার যে কিছুমাত্র কার্যকারিতা নেই তা প্রতিপন্ন করার জন্য তিনি লিখেছেন- কৃষক পরিশ্রম করে শস্য উৎপাদন করে প্রার্থনা করে নয়।

বাংলায় এ পর্যন্ত যে চিন্তা ও কর্মধারার বিকাশ হয়েছে তাতে মধ্যযুগীয় প্রভাব বেশি দেখা যায়। দেবেন্দ্রনাথের কাজে আমরা দেখতে পাই তিনি মানুষের মনকে ব্রহ্ম-পাদপীঠ বলে সম্মান দিয়েছেন। মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ সম্পর্কে প্রবন্ধে উল্লেখ করা হয়েছে, "দেবেন্দ্রনাথ রাশভারী লোক ছিলেন। তাই তার অন্তরের এই প্রগলভা ভক্তি তার বাইরের চেহারা ক্বচিৎ আলুথালু করতে পেরেছে।" বাংলার নব সাহিত্যের নেতা মাইকেল মধুসূদন দত্ত আশ্চর্য উদার চিত্ত নিয়ে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। জাতি-ধর্ম ইত্যাদির সংকীর্ণতা যেন জীবনে ক্ষণকালের জন্যও স্পর্শ করতে পারেনি। আর এ উদার চিত্ত কবি ইয়োরোপের ও ভারতের প্রাচীন কাব্যকলার শ্রেষ্ঠ সম্পদ যেভাবে আহরণ করে স্বদেশবাসীদের উপহার দিয়েছেন সেই কথা বাঙালি চিরদিনই বিস্ময় ও শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করবে। 

বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপ্যাধ্যায় শেষ পর্যন্ত শিল্পের ক্ষেত্রে থাকতে পারেননি; শেষ বয়সে ধর্মের ক্ষেত্রে অবতরণ করেন। তাঁর এ ধর্মালোচনায় দেখা যায় তার দেশহিতৈষণা। কিন্তু এ প্রেম খুব গভীর হলেও কিছু একরোখা, তাই শেষ পর্যন্ত জাতির ত্রাণকর্তার বড় আসন তার স্বদেশবাসীরা হয়ত তাকে দিতে পারবেন না। বঙ্কিমচন্দ্র জাতীয়তার যে রূপ দিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ তার সংকীর্ণতা ভেঙে তাকে বৃহত্তর করতে প্রয়াসী হন। রবীন্দ্রনাথ কবি, তাও আবার সূক্ষ্ম শিল্পী গীতিকবি; তাই যে মহামানবতার গান তিনি গেয়েছেন আমাদের দেশের স্থূল-প্রকৃতি জনসাধারণের জীবনে কত দিনে তার স্পন্দন জাগবে তা ভেবে পাওয়া দুষ্কর।

হিন্দু এ প্রবন্ধে-মুসলমান দাঙ্গার কথা বলা হয়েছে। এ হিন্দু- মুসলমান সমস্যা যেন বিধাতার জ্বালা এক তীব্র আলো। তবে সমাজের হিন্দু সঙ্গে সঙ্গে মুসলমান সমাজের জাগরণ যদি সত্য হয় তবে বাংলায় এক অভিনব জাতীয় জীবন গঠিত হবে। 

হিন্দু-মুসলমান দ্বন্দ্বের জটিলতা নিরসনে রামমোহনের ভূমিকা সৃষ্টিধর্মী ও সামঞ্জস্য প্রত্যাশী। সকল ধর্মের মূল শাস্ত্রের প্রতি গুরুত্ব দিলেও রামমোহন শেষ পর্যন্ত শিক্ষার ক্ষেত্রে চর্চা করতে বলেছেন। রামমোহন মনে করেন জ্ঞানই শ্রেষ্ঠ মুক্তির ক্ষেত্র। বাহির মুখো তথা জ্ঞানের দিকে ধাবিত হওয়ার জন্য বলেছেন। এই বাহির মুখো হওয়ার সাধনাই হয়ত বর্তমান বাঙালি জীবনে বড় সাধনা হয়ত এরই সাহায্যে সবলতার কাণ্ডজ্ঞান শ্রেষ্ঠতর পৌরুষ ইত্যাদি কল্যাণ পথের সম্বল আহরণ তার পক্ষে সহজ হবে। 

উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, 'বাংলার জাগরণ' প্রবন্ধে অবিভক্ত ভারতের বাংলা অঞ্চলে উনবিংশ ও বিংশ শতকে সমাজ সংস্কার আন্দোলনের কথা উল্লেখ করেছেন। বাংলা নবজাগরণের জনক রাজা রামমোহন এর কথা এবং তার অবদানের কথা ব্যক্ত করেছেন। জাগরণের বড় ধরনের প্রকাশ লক্ষ যুক্তিভিত্তিক যুক্তিচিন্তার সপক্ষে পরিচালিত ধর্মনিরপেক্ষ আন্দোলনের কথা ফুটে উঠেছে। এর সাথে সাথে যুক্তিবাদ, মানবতাবাদ, উপযোগবাদ, সমাজবাদ ও জাতীয়বাদের কথা ব্যক্ত করেছেন।
আপনারঅদৃশ্যমন্তব্য
Cancel