আমি ক্লান্ত প্রাণ এক, চারিদিকে জীবনের সমুদ্র সফেন, আমাকে দুদণ্ড শান্তি দিয়েছিল নাটোরের বনলতা সেন।- কবি কেন এমন বলেছেন তার ব্যাখ্যা কর।
জীবনানন্দ দাশ বাংলা কবিতায় নতুন বীক্ষাকাশ নির্মাণ করেন। বাংলা কাব্য জগতকে তিনি দেন নতুন মাত্রা। জীবনানন্দ দাশ রবীন্দ্রোত্তর যুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি। তার বনলতা সেন একটি সুবিখ্যাত কবিতা। এই কবিতায় প্রেম ও প্রকৃতি চেতনার অপূর্ব সমন্বয় সাধিত হয়েছে। দীর্ঘ ভ্রমণক্লান্ত কবির নীড়াশ্রয়ী মন তার কাঙ্ক্ষিত নীড়ের সন্ধান লাভ করেছে।
প্রেমের আকাঙ্ক্ষার বশবর্তী হয়ে মানুষ সংসার ছাড়ে, অনিশ্চিত পথের যাত্রী হয়ে উৎসর্গ করে জীবনকে। প্রত্যেক প্রেমিকপুরুষ তার ক্লান্তির অবসান ঘটাতে চায় প্রেমিকার বাহুবন্ধনের আশ্রয়ে। মানুষ তার সারা দিনের, সারা জীবনের ক্লান্তি দূর করে কাঙ্ক্ষিত নারীর সান্নিধ্যে। পুরুষের জীবন সমুদ্র সহস্র তরঙ্গের আঘাতে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। সফেন সমুদ্রে হাবুডুবু খেতে খেতে একটুখানি নীড়ের আশ্রয় আর নিবিড় শান্তি তার একান্ত কাম্য হয়ে ওঠে। এ প্রেমিকসত্তা চির অজর, অমর। কাল থেকে কালান্তরে, যুগ থেকে যুগান্তরে এ সত্তা সঞ্চালিত হয়ে চলেছে। বনলতা সেন কবিতায় পুরুষের এ প্রেমিকসত্তা তার কাঙ্ক্ষিত প্রেমময়ীকে খুঁজে পেয়েছে হাজার বছর পথ চলার পর। পুরুষের এ প্রেম চিরন্তন। অনির্বাণ শিখার মতো তা প্রেমিকের হৃদয়কে সর্বদা আলোকিত করে রাখে।
বনলতা সেন কবিতায় কবি জীবনানন্দ দাশের যে প্রেমানুভূতির
প্রকাশ ঘটেছে তা কেবল একজন মানুষের ব্যক্তি অনুভূতি নয়। কবির অনুভূতি এ কবিতায় সমগ্র পুরুষ জাতির প্রেমানুভূতিকে ব্যক্ত করে তুলেছেন। শ্রমক্লান্ত পুরুষ চিরকাল শান্তির অন্বেষণ করে চলেছে। এ শান্তির জন্য সে অনেক সময় ধরে অনেক পথ অতিক্রম করে ফিরছে। কিন্তু কোথাও সেই কাঙ্ক্ষিত শান্তিকে সে করতলগত করতে পারেনি। মানুষের প্রেমিক মন শান্তি পেতে পারে কেবল শাশ্বত নারীসত্তার সংস্পর্শে। এ কবিতায় কবির মন শেষ পর্যন্ত বনলতা সেনের সান্নিধ্যে এসে শান্তির সন্ধান পেয়েছে। কবি তাই নির্দ্বিধায় উচ্চারণ করেছেন,
"আমি ক্লান্ত প্রাণ এক, চারিদিকে জীবনের সমুদ্র সফেন,
আমারে দুদণ্ড শান্তি দিয়েছিল নাটোরের বনলতা সেন।"
বাস্তবে বনলতা সেনের কাছে ক্লান্ত শ্রান্ত কবি দুদণ্ডের শান্তি পেয়েছিলেন তার নীড়ের মতো চোখের আশ্রয়ে। এ দুদণ্ড শান্তি হচ্ছে ক্ষণিকতার চকিত উদ্ভাস। আসলে ক্ষণিকতাই হচ্ছে প্রেমের ধর্ম। কিন্তু দুদণ্ডের উষ্ণ অনুভব, প্রশান্তি, স্মৃতি ও স্বপ্নের জগতে কালের পরিধি অতিক্রম করে মানবের শাশ্বত অনুভবরূপে আত্মপ্রকাশ করল। এ প্রতিবিকাশে বনলতা সেন রূপান্তরিত হলো প্রেমের চির উজ্জ্বল প্রতীকে।
বনলতা সেন কবিতাটি কবির প্রেম ও প্রকৃতি চেতনার সমন্বিত রূপ। বনলতা সেন প্রেম ও সৌন্দর্যের মিশ্রণে এক অনুপম কবিতা। যুগ-যুগান্তরের পথচারী পুরুষ সত্তা এখানে খুঁজে পেয়েছে শাশ্বত নারী সভাকে। প্রেম ও সৌন্দর্যের অনিঃশেষ দীপ্তিতে মহীয়ান হয়ে উঠেছে সেই শাশ্বত নারী। যাকে পাওয়া যেকোনো পুরুষের জন্য সৌভাগ্যের বিষয়। কবি সেই সৌভাগ্যবানদের মধ্যকার
একজন প্রেমিক পুরুষ।