চোরাবালি কাব্য অবলম্বনে বিষ্ণু দের নগরভাবনার পরিচয় দাও। অথবা, চোরাবালি কাব্যে বিধৃত নগরসভ্যতার সংকট চিত্রায়ণে কবির দৃষ্টিভঙ্গি বিচার কর।
বাংলা আধুনিক কবিতার উত্তরণের পথে তিরিশের পাঁচ
কবির ভূমিকা আজ ইতিহাস। বাংলা কবিতাকে বিশ্বসাহিত্যের দরবারে পরিচিতিদানের ক্ষেত্রে রবীন্দ্র-নজরুলের পরে তিরিশের পঞ্চ কবির আত্মদানকে অস্বীকারের উপায় নেই। তিরিশের প্রধান সেই পাঁচ কবির একজন বিষ্ণু দে (১৯০৯-১৯৮২)। বিষ্ণুদের কবিতা, তার সমগ্র সাহিত্যকর্ম কিংবা তার জীবনাচরণ ইত্যাদি সম্পর্কে বহু সুপণ্ডিত নানা আঙ্গিকে আলোচনা করেছেন। বিষ্ণু দে'র চোরাবালি (১৯৩৭) কাব্যগ্রন্থটি পাশ্চাত্য রীতির পরিবৃত্তি ও নগরসভ্যতার সংকট চিত্রায়ণে বিশেষ ভূমিকা রয়েছে।
চোরাবালি কাব্যের অধিকাংশ কবিতায় কবির নাগরিকচেতনা প্রতিবিম্বিত হয়েছে। এ কবিতায় কলকাতা নগর সম্পর্কে বিষ্ণু দে'র লেখনী ছিল অতীত-বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নিয়ে, কোনোরকম খন্ডীভবনে নয়, সবচেয়ে বিচ্ছিন্নাশেও নয়; তার আত্মস্মৃতিতে ব্যক্তিগত অনুষঙ্গে ও পারিপার্শ্বিকতায় কলকাতা ধরা পড়ে প্রকৃত আবরণে এবং মমত্ববোধে। বিষ্ণু দে'র নাগরিক চেতনার প্রতিফলন হয়েছে চোরাবালি কাব্যের অধিকাংশ কবিতায়। ত্রিশোত্তর কবিদের মধ্যে সব কবিই নিজ নিজ অনুভবে নাগরিকবোধের আত্মীকরণকে মেনে নিয়েছেন মধ্যবর্তী ও আরোপিত চাপের সহযোগে। শহরের জটিল ও কঠিন জীবনযাত্রার রুদ্ধশ্বাস এবং যন্ত্রশিল্পের গ্রাসে দ্রুত বিলুপ্ত কলকাতা শহর ও শহরের অধিবাসীদের রূপরেখা অঙ্কিত হয়েছে বেকার-বিহঙ্গ, প্রথম পার্টি, টপ্পা ঠুংরী, কবিকিশোর প্রভৃতি কবিতায়।
"ট্রেন এল বলে হাওড়ায়।ওপারে স্টক এক্সচেঞ্জের এপারে রেলওয়ের হাওড়া,তারই মধ্যে বসে আছেন শিবসদাগরট্যাক্স হৃদয়স্পন্দে, ট্রাফিকের এটাকস্টিয়ার"। টিপ্পা-ঠুংরি]
তিনি বর্তমান নাগরিক সমাজের পুঁজিবাদী শ্রেণির চারিত্র্য উদ্ঘাটন করেছেন তার প্রথম পার্টি কবিতায় কবি পৌরাণিক অর্জুনের বৃহন্নলারূপী ধৃত চরিত্র ব্যবহার করে।
"এ আমার কাপুরুষতার প্রাণহীন গূঢ় ছন্দবেশ?ছিন্নহস্ত অহিংসার বৃহন্নলারূপ?” [প্রথম পার্টি)
মার্কসীয় বিচ্ছিন্নতার রূপায়ণে বিষ্ণু দে'র কবিমানস ব্যাপকভাবে প্রভাবিত হয়েছিল বিদেশি সাহিত্যের দ্বারা। ধনতান্ত্রিক সমাজের অবক্ষয়, শ্বাসরুদ্ধকর পরিবেশ তাকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করেছিল। ফলে তার কবিতায় পুঁজিবাদী সভ্যতার মর্মমূল থেকে উৎসারিত বিচ্ছিন্নতার ব্যাপক প্রকাশ ঘটেছে।
তার চোরাবালি কাব্যের গার্হস্থ্যাশ্রম, কবিকিশোর, দ্বিধাদম্পতি, প্রথম পার্টি, বেকারবিহঙ্গ, শিখণ্ডীর গান প্রভৃতি কবিতায় আত্মপ্রহেলিকাময় জীবনযাপনে অভ্যন্ত আপাতভদ্র শ্রেণির মানুষগুলোকে উন্মুক্ত করে দেখাতে চেয়েছেন যাতে ব্যক্ত হয়েছে বণিক সভ্যতার আত্মক্ষয় আর কালো-বাষ্পে ঘেরা মধ্যবিত্তের বিকৃতি ও নামেমাত্র মসৃণতা। যথা:
"অস্তাচলের আঁধারেই কিবা আশা?এ মরা-শইরে নীড়সন্ধানী মনহারাল চতুর উভচর দিশা তার।" [বেকারবিহঙ্গ]
গার্হস্থ্য শ্রম কবিতাটির বিষয় পুঁজিবাদের আময় থেকে উৎসারিত বিচ্ছিন্নতাকে তিনি মননধর্মী বুদ্ধিবাদী কবিতায় স্থান দিয়েছেন-
"সুযোগ পেয়ে তো তবে পাশাপাশি মিলি?আমাদের ভালোবাসা প্রাকৃতিক লিলি?" [গার্হস্থ্যাশ্রম]
চোরাবালি কাব্যে বিষ্ণু দে মধ্যবিত্ত নাগরিক শ্রেণির প্রেমের আধুনিক ধারণার চিত্রায়ণ ঘটিয়েছেন। আর এ কারণেই পুঁজিবাদী সমাজে ব্যক্তিজীবনে সৃষ্টি হয়েছে বহুমাত্রিক জটিলতা। জীবিকার সংকট, বেকারত্ব, রাষ্ট্রনৈতিক অস্থিরতা, শ্বাসরুদ্ধকর যান্ত্রিক পরিবেশ
প্রভৃতি সমস্যা সুন্দর জীবনের স্বপ্নকে ব্যর্থতায় পর্যবসিত করছে। ব্যর্থতা, হতাশা, অসহায়ত্ব মানুষকে বিচ্ছিন্নতায় মগ্ন করেছে। ফলে কবির চেতনায় জন্ম হয়েছে অবিশ্বাস, সন্দেহ ও হতাশা। এই সমস্যাসঙ্কুল, হতাশাপূর্ণ, বিশৃঙ্খলা এবং অবক্ষয়িত নাগরিক জীবনে অন্যান্য কবির মতো বিষ্ণু দে ও অবসাগ্রস্ত হয়ে পড়েন এবং একাকী উচ্চারণ করেন-
'কার্নিভাল এ জীবনে আমার ঘুম পায় আজ।'
অবসাদগ্রস্ত হয়ে বলেন- রাত্রির বিশাল মুখ বাতায়নে উঁকি দেয় কালো, একাকী রয়েছি বসে অরণ্যের বাংলোর ঘরে আকাশে নেইকো আলো, পৃথিবীর নিভে গেছে আলো। এলোমেলো বিশৃঙ্খল দুস্থ রোগদুষ্ট সভ্যতা বিষ্ণু দে'র সংবেদনশীল কবিমনে বিচ্ছিন্নতার সংক্রমণ ঘটিয়েছে। গ্রামে, গঞ্জে, শহরে সর্বত্র এক উন্মত্ত অস্থিরতা প্রত্যক্ষ করেছেন তিনি। তার মনে হয়েছে এই অন্তঃসারশূন্য ফাঁপা সভ্যতায় আবির্ভূত মানুষগুলোও ফাঁপা। কবি বিষ্ণু দে'র মনে একদিক যেমন আবেগকে অতিক্রম করে বাস্তবকে রূপায়ণের প্রয়াস পরিলক্ষিত অন্যদিকে তেমনি তার কবিতায় রোমান্টিক মনোভাবের আয়রনিও লক্ষ্যযোগ্য। বিষ্ণু দে'র এই রোমান্টিক মনোভাবের আয়রনি রবীন্দ্র রোম্যান্টিসিজমও বিচূর্ণ হয়েছে। রুগ্ন নাগরিক সভ্যতা যে ফাঁপা যে ফাঁপা মানুষদের জন্ম দিয়েছে সুরেশ সেই বিচ্ছিন্ন বিড়ম্বিত জীবন বহন করে চলেছে। স্বাস্থ্যহীন সুরেশ তাই সিনেমায় সক্রেটিসের জ্ঞানদাত্রী প্লেটনিক প্রেমের প্রতীক ইয়াটিমাকে খুঁজে বেড়ায়। তারই প্রতি কবির আরাধনা-
"পঞ্চশরে দগ্ধ করে করেছে একি সন্ন্যাসী।
বিশ্বময় চলেছে তার ভোজ।
মরমিয়া সুগন্ধ তার বাতাসে ওঠে প্রশ্বাসি,
সুরেশ শুধু খায় দেখি গ্লুকোজ।” [শিখন্ডীর গান]
বিষ্ণু দে'র কবিতার বিষয়ের পাশাপাশি শিল্পপ্রকরণেও বিচ্ছিন্নতার প্রকাশ ঘটিয়েছেন। কাব্য কবিতার নামকরণ থেকে শুরু করে কবিতার শব্দ এবং অলংকারের মধ্যেও বিচ্ছিন্নতার সন্নিবেশ ঘটেছে। তাইতো তিনি কাব্যের নামকরণ করেছেন চোরাবালি।
বন্ধ্যা শহুরে জীবনে মলিনতা ও নৈতিকতা এবং অবক্ষয়ের পরিপ্রেক্ষিতে বিষ্ণু দে'র কবিসত্তা নিত্যন্ত নিঃসঙ্গ ও বিচ্ছিন্নবোধ করেছে। পুঁজিবাদী শ্রেণির শিরায়-উপশিরায় শোষণের চক্রান্ত। আত্মকেন্দ্রিক জীবনের ভার দুর্বহ হয়ে উঠেছে। তাই, অতিবাস্তববাদী জৈব জীবন ও সামাজিক জীবনকে বিশৃঙ্খলা করতে চাইছে- খুঁজছে চেতনার বিসর্জনে মুক্তির পথ। চোরাবালি কাব্যের সন্ধ্যায়, যযাতি, অপস্পমার প্রভৃতি বহু কবিতায় এই অতি বাস্তববাদের প্রভাব লক্ষণীয়-
"অনেক দিনের অনেক জ্ঞানের চরম ক্ষতি,অনেক পাপের পরম তাপের বিষম বোঝাঅনিকেত মনে যক্ষের কূট, প্রশ্ন আনে। ব্যাধভয়াহত, তাইতোপাহাড়ে আড়াল খোঁজা।" [যযাতি)
বিষ্ণু দে কখনো বিচ্ছিন্নতা ও রিক্ততা দূর করতে প্রকৃতির অপার রহস্যের জালে নিজেকে আবদ্ধ করেছেন। তার বিচ্ছিন্নতার চেতনা বিশ্বব্যাপী পরিব্যাপ্ত হলেও, তাতে হতাশার ছাপ নেই। বিচ্ছিন্নতা মুক্তিপ্রত্যাশী কবি স্বীয় চিত্তকে সর্বত্র ছড়িয়ে দেওয়ার প্রত্যয় থেকে। অন্যদিকে কবির চোখে ধরা পড়েছে নগরীর চলমান জীবনস্রোতের কলধ্বনি, যেখানে একাকিত্ব, ক্লান্তি, অবক্ষয়, অভ্যাসের পরিবর্তে রয়েছে জনতার জীবিকা-সন্ধানের জন্য উদভ্রান্তি ও শক্তিক্ষয়ের অপচয়, জীবনযাপনের আপাত অর্থহীনতা-
'জনস্রোতে ভেসে যায় জীবন যৌবন ধনমানআশে আর পাশে, সামনে পিছনেএতলোক জীবনের বলি।' [টপ্পা-ঠুংরি]
উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, বিষ্ণু দে'র চোরাবালি কবি ব্যক্তি সংকটকে যুগ সংকটের সাথে সম্পৃক্ত করে দেখেছেন এবং নাগরিক মধ্যবিত্তের সংকটকে চিত্রিত করেছেন। এলিয়টের কবিতায় চিত্রিত নাগরিক জীবনের অনুষঙ্গের ছায়াপাতে বিষ্ণু দে নগরজীবনকে যেমন আমাদের মতো বিন্যস্ত করতে চান সেরকমই ঔপনিবেশিক কলকাতার গমনশীল প্রতিবেশ রূপায়ণে বা দ্বান্দ্বিকতার কার্যকারণও কবির নিকট অজ্ঞাত ছিল না। তার কবিতায় বিচ্ছিন্নতার রূপায়ণে সমকালীন যুগের প্রভাব নানাভাবে কাজ করছে। দেশবাসীর পরাধীনতা, মধ্যবিত্তজীবনের যন্ত্রণা, সংকটপূর্ণ নগরজীবন এবং মূল্যবোধের সব্বৈ অবক্ষয়ের পটভূমিতে বিষ্ণু দে'র কাব্য পরিমণ্ডল গড়ে উঠেছে। ফলে, তার কাব্যে বিধৃত নগরসভ্যতার সংকট জীবনের বিশৃঙ্খল রূপছিন্নতা নানা বিভঙ্গের দৃশ্য অত্যন্ত নিগূঢ়ভাবে চিত্রিত হয়েছে।