মৈমনসিংহ গীতিকার নারী চরিত্রগুলো পুরুষ চরিত্রের তুলনায় সফল ও শৈল্পিক।-আলোচনা কর। অথবা, 'মৈমনসিংহ গীতিকা'য় পুরুষ চরিত্রগুলো নারী চরিত্রের তুলনায় দুর্বল কি না আলোচনা কর।
লোকগাথা আঠারো শতকের অন্যতম সাহিত্যধারা।
অধিকাংশ লোকগাথাই ছিল অলিখিত, লোকমুখে প্রচলিত; ফলে সেগুলোর ভাব, ভাষা ও উপমায় প্রক্ষেপণ ঘটেছে। উনিশ শতক পর্যন্ত গাথাগুলোর প্রায় সবটিতেই পুরুষ চরিত্র অপেক্ষা নারীর ভূমিকা প্রধান। গীতিকাগুলোর কাল নির্ণয় দুরূহ। এ ধারার সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হলো মৈমনসিংহ গীতিকা। দীনেশচন্দ্র সেন ময়মনসিংহের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে এর পালাগুলো সংগ্রহ করে প্রকাশ করেন। এগুলোতে পল্লির লোকজীবন চমৎকারভাবে ফুটে উঠেছে। গ্রন্থটি বিষয়মাহাত্ম্য ও শিল্পগুণে শিক্ষিত মানুষেরও মন জয় করে।
মৈমনসিংহ গীতিকায় নারী চরিত্রের স্বরূপ উদ্ঘাটন তৎকালীন সমাজের সামগ্রিক পরিবেশের প্রভাবক। নারীর জীবনে কষ্ট, দুর্ভোগ ঘটেছে পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীকে অবদমিত, বঞ্চিত, অপমানিত করার কারণে। সমাজ অঙ্গুলি নির্দেশ করে সাধারণকে যে পথ দেখিয়ে দেয় সে পথ ধরেই তারা অগ্রসর হয়। কিন্তু র
সেবনসিংহ গীতিকার অসাধারণ নায়িকাগুলোর প্রেমানুভূতি প্রধান্য লাভ করেছে। প্রেমের জন্য সব রকম দুঃখকে তারা বরণ এরে নিয়েছে। বাংলা সাহিত্যের অন্যান্য নায়িকা চরিত্রের ব্যতিক্রম চেতনার প্রকাশ ঘটিয়েছেন পল্লিকবিগণ।
মেমনসিংহ গীতিকার দস্যু কেনারামের পালা ছাড়া বাকি নয়টি পলার মুখ্য বিষয় নরনারীর লৌকিক প্রেম। এ প্রেমের পরিণতি কোনোটির মিলনান্তক, কোনোটির বিয়োগান্ত। নায়িকার নামানুসারে নীতিকাগুলোর নামকরণ হয়েছে। গীতিকাগুলোতে পুরুষ চরিত্রের তুলনায় নারী চরিত্রের ভূমিকা উজ্জ্বল ও প্রাণবন্ত। দেওয়ানা মদিনা পালায় দেখা যায়, বানিয়াচঙ্গের সোনাফর দেওয়ানের দুই ছেলে আলাল ও দুলাল। দেওয়ানের স্ত্রী মৃত্যুশয্যায় স্বামীকে অনুরোধ করে গেছেন তার মৃত্যুর পর যেন স্বামী বিয়ে না করেন, সন্তানদের জন্য যেন ঘরে সৎ মা না আনেন। সোনাফরের স্ত্রী সৎ মায়ের অত্যাচার বুঝাতে একটি কবুতরের গল্প বলেন যেখানে স্ত্রী কবুতর মারা গেলে পুরুষ কবুতরটি বিপাকে পড়ে। ছানা দুটিকে রেখে খাবার আনতে যাবে নাকি ছানাদের পাহারা দেবে? তাই একটি নতুন স্ত্রী কবুতর আনে। সেই সৎ মা ছানা দুটিকে মেরে ফেলে। এরকম কাতরভাবে সোনাফর দেওয়ানের স্ত্রী অনুরোধ করে আলাল-দুলালকে স্বামীর হাতে সপে দিয়ে মারা যান। স্ত্রীর মৃত্যুর পর তাদের সংসার এলোমেলো হয়ে পড়ে। উজির-নাজির সর্বক্ষণ পরামর্শ দেয় দ্বিতীয় বিবাহ করার জন্য। কিন্তু স্ত্রীর অনুরোধের কথা ভেবে তিনি রাজি হন না। অবশেষে উজির-নাজিরের পরামর্শে সোনাফর রাজি হন এবং সৎ মা আনেন। কিন্তু ছেলে দুটিকে দূরে সরিয়ে রাখেন। নতুন স্ত্রী দেখতে পেল দেওয়ান তাকে সময় দেয় কম, বাচ্চাদের দিকে মনোযোগ বেশি। তাতে সোনাফরের স্ত্রী ক্ষিপ্ত হয় এবং নতুন পরিকল্পনা করে। স্বামীকে বলে বাচ্চাদের তার কাছে আসতে, সে যত্ন করে রাখবে।
সৎমা খুব আদর করে ঠিকই কিন্তু মনে মনে চিন্তা করে পথের কাঁটা সরানোর। একবার সেই সুযোগ পেয়েও যায়। নৌকাবাইচে তাদেরকে পাঠায় এবং মাঝি হিসেবে পাঠায় এক জল্লাদকে। শেষ পর্যন্ত তারা জল্লাদের কৃপায় বেঁচে যায়। আলাল আশ্রয় লাভ করে সেকেন্দার দেওয়ানের ঘরে, দুলাল ঠাঁই নেয় সাধারণ গৃহস্থ ঘরে, পরে মদিনার সঙ্গে বেড়ে ওঠে, শেষ পর্যন্ত দাম্পত্য বন্ধনে আবদ্ধ হয়। কিছুদিন পর আলাল তার ভাই দুলালকে খুঁজে পায় এবং সৎ মাতার বিরুদ্ধে তারা অভিযান চালায় ও পিতৃ দেওয়ানগিরিতে বহাল হয়। দুলাল মদিনাকে তালাক দেয়।
মদিনার ভাইয়ের হাতে তালাকনামা ধরিয়ে দিয়ে দুলাল চলে যায় বানিয়াচঙ্গে এবং দ্বিতীয় বিয়ে করে। এদিকে মদিনা তালাকের কথা বিশ্বাস করে না। হেসে উড়িয়ে দেয় এবং দুলালের পথ চেয়ে রয়। কিন্তু সে ফেরে না। এরপর একদিন মদিনা তার ছেলে এবং ডাইকে পাঠায় বানিয়াচঙ্গ। দুলাল তাদের বলে, সে আর ফিরবে না। তারা যেন আর না আসে। এতে দুলাল লজ্জায় পড়ে যাবে, সব জানাজানি হয়ে যাবে। এসব খবর শুনে মদিনা দুঃখে পাগল হয়ে
যায়। একসময় নাওয়া-খাওয়া ছেড়ে মদিনা মৃত্যুবরণ করে। ছ'মাস পর, দুলাল তার ভুল বুঝতে পেরে মদিনার কাছে ফিরে আসে ঠিকই, কিন্তু ততদিনে সেই মদিনা কবরে ঘুমিয়ে। দুলাল কবরের ওপর পড়ে কান্নাকাটি করে। তারপর আর ফেরে না সেই বানিয়াচঙ্গে। মদিনার কবরের কাছে ঘর বানিয়ে সেখানে পড়ে থাকে। অন্যদিকে, মহুয়া পালায় দেখা যায়, নদের চাঁদের বসতভিটা সুসং দুর্গাপুর উপজেলা সদর থেকে দক্ষিণ-পূর্ব দিকে এবং ঝাঞ্ছাজাইল বাজার থেকে পূর্বে বাউরতলা গ্রামের পাশে। সুদর্শন পুরুষ নদের চাঁদ ছিলেন এক জমিদারের দেওয়ান। অপরপক্ষে, রূপবতী মহুয়া হুমরা বেদের পালিত কন্যা, যাকে শিশুকালে হুমরা বেদে নেত্রকোনার কাঞ্চনপুর থেকে ডাকাতি করে নিয়ে আসে। বেদে মহুয়া যখন নদের চাঁদের গ্রামে সাপের খেলা দেখাতে আসে তখন মহুয়ার রূপে মুগ্ধ হয়ে নদের চাঁদ তাকে প্রণয় নিবেদন করে। মহুয়াও নদের চাঁদের প্রণয়ে সম্মতি জ্ঞাপন করে। কিন্তু দুজনের প্রণয়ের মাঝে বাধা হয়ে দাঁড়ায় সর্দার হুমরা বেদে। একদিন মহুয়া নদের চাঁদকে নিয়ে পালিয়ে যায়। এদিকে হুমরা বেদে তা জানতে পেরে দলবল নিয়ে তাদের পিছু ধাওয়া করে। অবশেষে তারা মহুয়া এবং নদের চাঁদকে ধরে ফেলে। হুমরা বেদে নদের চাঁদকে মেরে ফেলার সিদ্ধান্ত নেয়। সর্দার মহুয়ার হাতে বিষলক্ষার ছুরি দিয়ে নদের চাঁদকে মেরে ফেলতে বলে। বিষলক্ষার ছুরি নিয়ে মহুয়া নদের চাঁদের দিকে এগিয়ে যায়। নদের চাঁদের সম্মুখে পৌঁছে বিষলক্ষার ছুরি দিয়ে তার নিজের বক্ষ বিদীর্ণ করে এবং মাটিতে ঢলে পড়ে। প্রণয়পিয়াসি নদের চাঁদকে হুমরা বেদের সঙ্গীরা মেরে ফেলে। মহুয়া ও নদের চাঁদের এ আত্মত্যাগ চিরন্তন প্রেমকে মহিমান্বিত করেছে।
উভয় পালায় আমরা কর্তব্যপরায়ণ, পতিপ্রাণা, প্রতিবাদী নারীসত্তার পরিচয় পাই, যারা সংস্কার পরিপূর্ণ সমাজের বন্ধনকে তোয়াক্কা করে না। তাই মদিনার দারিদ্র্য পরিপূর্ণ সংসারগৃহ, স্বামী বিরহ আমাদের অন্তরকে কাঁদায়। অভাব, দুঃখ, কষ্ট, উৎপীড়নকে জয় করে এসব পালার নায়িকা মহান প্রেমের প্রতীকরূপে প্রতিষ্ঠিত। কিন্তু নায়ক চরিত্রে দেখা যায় বিপরীত দৃশ্য। পালাগুলোতে নায়িকারা যতটা সক্রিয়, নায়করা ততটাই নিষ্ক্রিয়। প্রায় প্রতিটি পালায়ই গ্রাম্য কৃষক কবিকুল যে মহীয়সী আদর্শের বাণী সর্বসমক্ষে তুলে ধরেছেন, তাতে সমাজ সংসারে দৈনন্দিন কর্তব্যকর্মের মধ্য দিয়ে নায়ক-নায়িকার জীবনে আগতমান দুর্বিষহই চিত্রিত, যা প্রায়শ ক্ষেত্রে অতিক্রম করে গেছে নায়িকারা। তবে রক্ষণশীল সমাজের সব বঝড়ঝঞা যেন নায়িকাদের জীবন মোথিত করে প্রবাহিত হয়েছে। কিন্তু সে ঝড়ে কোনো নায়িকাই ম্লান হয়নি, ম্লান হয়ে গেছে নায়করা। কবিগণ নায়িকাদের মহান আদর্শের প্রেমের প্রতীকীকল্পনা করলেও মদিনার মতো নারীর সন্ধানও দিয়েছেন। যে শতছিন্ন, লজ্জা সম্ভ্রম রক্ষার বস্তুটুকু আপন দেহে পরিধান করে, স্বামীর প্রতিটি কার্যে প্রবল উৎসাহে সাহায্য করতেও কুণ্ঠিত হয়নি।
উভয় পালার নারী চরিত্রসমূহের মধ্যে রয়েছে জীবনতৃষ্ণা ও জীবন
আকাঙ্ক্ষার ব্যাকুলতা; যা পুরুষদের মধ্যে দেখা যায় না। নারী
চরিত্রসমূহের আত্মবিসর্জন বা আত্মত্যাগের পিছনেও কাজ করে
পারলৌকিক মিলনাকাঙ্ক্ষা বা পূর্ণ প্রত্যাশা। এসব পালার নারীরা আত্মবিসর্জন করলেও সবকিছুর মূলে রয়েছে জীবনের প্রতি তৃষ্ণা, অতৃপ্ত বাসনা ও বেঁচে থাকার আকাঙ্ক্ষা, যা পুরুষদের মধ্যে নেই। মহুয়া, মলুয়া, মদিনা, লীলা তাদের কেউই প্রেমাস্পদকে মর্ত্যজীবনের বাইরে প্রত্যাশা করেনি। পরলোকে কিংবা অন্য কোনো জগতে তারা মিলনাকাঙ্ক্ষা নয়। এ থেকে বুঝা যায় যে, তাদের জীবনতৃষ্ণা বিপুল। মানবিক চেতনায় সচেতন থেকেই পালাকারগণ চরিত্র চিত্রণ করেছেন। এজন্য পালাগুলোতে মানবীয় বৃত্তি ও মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ড. আশুতোষ ভট্টাচার্য মনে করেন, "পূর্ব মৈমনসিংহ গীতিকাগুলো প্রধানত পরিণত বয়স্কা কুমারীর স্বাধীন প্রেমের অধিকার ও ব্যক্তিগত হৃদয় বেদনা লইয়াই রচিত। এসব গীতিকায় নারীরা এক প্রেম শক্তির অধিকারিণী। তারা প্রেম, নারীত্ব, সতীধর্মে অবিচল। কাহিনির এ ধারা আমাদের লোককবিদের হাতে মাধুর্য লাভ করেছে।"
উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, লোকমুখে প্রচলিত পালাগুলোর ভাব, ভাষা ও উপমায় যে প্রক্ষেপণ ঘটেছে তাতে গাথাগুলোর প্রায় সবটিতেই নারীর ভূমিকা প্রধান। জীবনবাদী বাঙালির জীবনে লোকাচারের ফলে এ প্রাধান্যের উদ্ভব দৈববলে সংঘটিত হয়েছে, এমন ভাবার কারণ নেই। প্রাত্যহিক জীবনচর্চা ও. জীবনচর্যা তাদের টেনে নিয়ে গেছে লোকাচার পরিপালনের উপল উপকূলে, প্রতিষ্ঠিত করেছে নারীর আসন। সময়ের বিবর্তনে এসব লোকাচারের কতক জনমানস হতে অপসৃত হয়ে গেছে কিন্তু কতিপয় লেবাস পাল্টিয়ে ধর্মীয় পরিমণ্ডলে হয়েছে আত্মীকৃত।