রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সংকলিত লোকছড়ায় প্রতিফলিত বাংলার সমাজজীবনের পরিচয় দাও। অথবা, লোকছড়ায় সমাজচিত্র প্রতিফলনের কয়েকটি উদাহরণ দাও।
বাংলা লোকসাহিত্যে ছড়া বিশিষ্ট স্থান অধিকার করে আছে। শিশুমনের উপযোগী করে এগুলো রচিত। এগুলো সৃষ্টি হয়েছে লোকপরম্পরায় নারী-পুরুষ উভয়ের মুখে মুখে। কাল থেকে কালান্তরে, স্থান থেকে স্থানান্তরে ছড়ায় নানা সংযোজন, বিয়োজন বা পরিবর্তন ঘটে। তাই এগুলোকে সুনির্দিষ্ট কাল বা স্থানের গণ্ডিতে চিহ্নিত করা দুষ্কর। তবু স্থান-কালের প্রভাব ছড়ায় থেকে যায়। আর সে জন্যই ছড়ায় বাঙালির সামাজিক, অর্থনৈতিক, পারিবারিক ও সাংস্কৃতিক জীবনের নানা পরিচয় খুঁজে নেওয়া সম্ভব হয়।
প্রাচীন বঙ্গদেশে অর্থনৈতিক জীবনের ভিত্তি ছিল শিকার, কৃষি ও সামান্য কুটির শিল্প। কালপরিক্রমায় ধীরে ধীরে ব্যবসাবাণিজ্য এবং অনেক পরে শিল্পের বিকাশ ঘটে। বাংলাদেশের প্রকৃতি আবহমানকাল ধরে কৃষিকাজের যথেষ্ট অনুকূল। তাই কৃষিই ছিল বাঙালির অর্থনৈতিক জীবনের মূল ভিত্তি। বাংলাদেশের প্রধান কৃষি ফসল ধান। ছড়ায় নানা রকম ধানের নাম পাওয়া যায়। যেমন- আমন, উড়কি, কাঁকুয়া, ধন্নি, শালি, যাইট্যা ইত্যাদি। ধানের পরেই উল্লেখযোগ্য কৃষি ফসল ছিল আখ ও সরষে, কলাই, আখ, ছোলা ইত্যাদি শস্য; কচু, কাঁচকলা, কুমড়ো, চালকুমড়ো, ক্ষিরা, চালতা, ঝিঙে, আলু, শিম ইত্যাদি তরকারি; কচু, কলাই, কলমি, হিঞে, পুঁই, পাট, ঢেঁকি, ডাঁটা, পটল, পালং ইত্যাদি শাক; আম, আমড়া, আতা, কলা, কাঁকুর, কাঁঠাল, কুল, পেয়ারা, বাঙ্গি, বেল, লেবু ইত্যাদি ফল; আদা, এলাচ, পেঁয়াজ, মরিচ, রসুন, হলুদ ইত্যাদি মশলা, তিল, রাই, সরিষা ইত্যাদি তেল। এছাড়াও ছড়ায় পান, তামাক, সুপারি, ইক্ষু, তুলো, নীল ইত্যাদি কৃষিজাত দ্রব্যের উল্লেখ আছে।
প্রাচীন ও মধ্য যুগের বাংলায় কৃষির পাশাপাশি গড়ে উঠেছিল কৃষিকেন্দ্রিক ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্প। বাংলার বস্ত্রশিল্প সুনাম অর্জন করেছে সুপ্রাচীনকাল থেকে। ছড়ায় চরকায় সুতো কাটা, তাঁতে কাপড় বোনা ও নকশা কাটার উল্লেখ রয়েছে। তাঁতশিল্প যে এক সময় তাঁতির জীবনে সচ্ছলতা এনেছিল ছড়ায় তার সমর্থন মেলে। যেমন-
"চরকা আমার ভাতার পুত,
চরকা আমার নাতি।
চরকার দৌলতে আমার,
দুয়ারে বাঁধা হাতি।"
সেকালে ঢাকাই শাড়ির ছিল বিপুল সমাদর। অন্যান্য শাড়ির মধ্যে ছড়ায় নীলাম্বরী, শঙ্খপাড়, আগুনজ্বালা ও মিঠাইবান্ধা শাড়ির উল্লেখ রয়েছে। সুতোর শাড়ি ছাড়াও প্রচলিত ছিল রেশমি শাড়ি। এগুলো পাটের শাড়ি, তসর, গরদ ইত্যাদি নামে পরিচিত ছিল। ছড়ায় এর সমর্থন মেলে। সেকালে বঙ্গদেশে তুলোর পাশাপাশি গুটি পোকারও চাষ হতো। কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রেও বাংলার রেশম জাতীয় বস্ত্রের প্রশংসা আছে। বাংলায় সেকালে কাঠশিল্প, মৃৎশিল্প ও লৌহশিল্পের অস্তিত্ব ছিল। সে সম্পর্কে ধারণা করা হয় ছড়ায় এসব শিল্পজাত সামগ্রীর নাম এবং ছুতোর, কুমোর ও কামারের উল্লেখ রয়েছে। কাঠের কাজে ছুতোরদের দক্ষতার পরিচয় পাওয়া যায় নৌকা, গরুর গাড়ি, পালকি, রথ, পালঙ্ক ইত্যাদি তৈরিতে। কুমোররা মাটির তৈরি হাঁড়ি, সরা, কলসি ইত্যাদি তৈরি করতো। ছড়ায় নৌকা ও অলংকারের ব্যাপক উল্লেখ রয়েছে। সেকালে নৌ ও অলংকার শিল্পের অস্তিত্বের সমর্থন মেলে। এমনিভাবে ধারণা হয় বে. সেকালে শাঁখ, কাঁসা, আলতা ও পাটিশিল্পের প্রচলন ছিল। বাঙালির প্রাচীন পেশা ছিল বাণিজ্যযাত্রা। ভাদুলী ব্রতের ছড়ায় এর সমর্থন মেলে। সেকালে বঙ্গদেশের সওদাগরেরা সুপারি, পান, নারকেল, সুতিবস্ত্র ইত্যাদির বিনিময়ে সোনা, মুক্তা, পান্না, শঙ্খ ইত্যাদি নিয়ে আসত।
সেকালে গ্রাম্য হাটকে কেন্দ্র করে স্থানীয় পণ্যদ্রব্য বেচাকেনা চলত। ধান-চাল, কাপড়-চোপড়, বাসন-কোসন ইত্যাদি কেনাবেচাকে কেন্দ্র করে হাট, গঞ্জ এবং ক্রমে গ্রামীণ নগর গড়ে ওঠে। এভাবে ব্যবসা বাণিজ্যের প্রসার ঘটে। ছড়ায় তার সমর্থন মেলে। বাঙালির প্রাচীন সামাজিক-অর্থনৈতিক জীবনকে কেন্দ্র করে সেকালে নানা পেশা ও বৃত্তি গড়ে উঠেছিল। মূলত কৃষি থেকেই প্রাচীন বাঙালি সমাজের বড় অংশের জীবন ও জীবিকার উপকরণ পাওয়া যেত। সেই সঙ্গে কুটির শিল্পকে কেন্দ্র করে প্রাচীনকালে বাংলায় বিভিন্ন পেশার সৃষ্টি হয়েছিল। ছড়ায় এদের উল্লেখ পাওয়া যায়। কৃষিজীবীদের মধ্যে কৃষকই ছিল প্রধান। যেমন- "জল জল ইন্দ্রের জল / পুরুষের মধ্যে চাষার দল।" আর ছিল হাল্যা (গৃহভৃত্য চাষি) ও খেতমজুর। গ্রামবাংলার অন্যান্য বৃত্তিধারীদের মধ্যে ছিল নাপিত, মালাকার, জেলে (মাছুয়া), স্যাকরা, বেনে, তেলি, কলু, কামার, কুমার, তাঁতি, ঠাঠারি (কাঁসারি), কাহার বা বেহারা (পাল্কি বাহক), ধোপা, চুলি, বাবুই (পান চাষি), ময়রা, মাঝি, মালি, ছুতার, নট, নটী, গোয়ালা, স্বর্ণকার ইত্যাদি। এছাড়াও ছড়ায় গোমস্তা, পেয়াদা, বাজনদার, মজুর, মোক্তার, সেপাই ইত্যাদি বৃত্তিধারীর উল্লেখ পাওয়া যায়। ডোম, বাগদি, হাঁড়ি প্রভৃতি অনার্য অধিবাসীদের প্রসঙ্গও ছড়ায় পাওয়া যায়। যেমন-
১. সরে শোও রে ডোমের বেটা গায়ে দিও না হাত।
বকতে ছিল রে ডোমের বেটা তাইতি খাই তোর ভাত।
২. পিরিতে মজিলে মন।
কিবা হাড়ি কিবা ডোম।
সেকালে পেটের দায়ে অনেকে চুরি-ডাকাতিতে লিপ্ত হতো। মেয়েরা গৃহস্থালি ছাড়াও নানা কাজে যুক্ত থাকত। কেউ সুতো কাটত, কেউ সাপের খেলা দেখাত। কেউ কেউ স্বাধীন পেশাও বেছে নিত। কেউ কেউ দাসীর কাজ করতে বাধ্য হতো। মদ বেচে কিংবা দেহ ব্যবসা করেও কেউ কেউ জীবিকা নির্বাহ করতো। ছড়ায় পেশা ও বৃত্তিবিন্যাসের দিক থেকে যাদের উল্লেখ আছে তাদের মধ্যে শ্রেণিবৈষম্যও দেখা যায়। সম্পদ ও সচ্ছলতার দিক থেকে তাদের কেউ উচ্চবিত্ত, কেউ নিম্নবিত্ত। নায়েব, গোমস্তারা ছিল উচ্চবিত্তের। খাজনা আদায় করতে গিয়ে তারা প্রজাদের পীড়ন করতো। গরিব কৃষকরা প্রায়শ জমিদারের খাজনা দিতে গিয়ে সংকটে পড়ত। যেমন- 'আষাঢ় মাসে খাজনা দিতি/ পিরান ফাইট্যা যায়'। গবেষকদের ধারণা, বঙ্গদেশে খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম-চতুর্থ শতকের দিকে মুদ্রার প্রচলন হয়। পাল আমলে রৌপ্য ও তামার মুদ্রার চল ছিল। সেন আমলে কড়ির চল ছিল বেশি। ছড়ায় মুদ্রা ও কৃষি বিনিময়ের উল্লেখ পাওয়া যায়। সেকালে কড়ি, টাকা, মোহর বা স্বর্ণমুদ্রার প্রচলন ছিল। বন্ধকী প্রথাও বলবৎ ছিল। গ্রাম বাংলায় কেনাবেচার কেন্দ্র ছিল হাট। ছড়ায় নানা প্রসঙ্গে হাটের উল্লেখ পাওয়া যায়। যেমন-
"হাটে যাও রে ছনছনি
আমার জন্য কিনে আন তামাক ডাল আর চিনি।"
উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, খ্রিস্টীয় তৃতীয়- চতুর্থ শতকে বা তারও পরবর্তীকালে বঙ্গে গ্রামীণ নগরজীবনের পত্তন শুরু হয়। সেকালে নগর ছিল সামন্ত শাসনের কেন্দ্রবিন্দু। নগর জীবনের সঙ্গে ছিল বিলাস-ব্যাসনের যোগ। নগরের সঙ্গে যে সম্পদ ও সচ্ছলতার যোগ ছিল ছড়ায় তার ইঙ্গিত মেলে।' সাহিত্য শিল্প সমাজ বিচ্ছিন্ন কোনো বিষয় নয় তা ছড়ার পাঠ থেকে জানা যায়। এভাবেই ছড়ায় সেকালের বাঙালির অর্থনৈতিক জীবনের নানা ইঙ্গিতময় ছবি, নানা পেশা ও বৃত্তির পরিচয় ফুটে উঠেছে।