জগদীশ গুপ্তের 'অসাধু সিদ্ধার্থ' উপন্যাসের নামকরণে সার্থকতা বিচার কর
কোনো বিষয়ের সাথে প্রাথমিক পরিচয়ে মুখ্য ভূমিকা পালন করে সেই বিষয়টির নাম। নামের মাধ্যমেই সেই বিষয়ের তাৎপর্য সম্পর্কে প্রাথমিক ধারণা বা জ্ঞান লাভ করা যায়। শিল্পসাহিত্যের ক্ষেত্রেও কোনো বিষয়ের নাম ব্যাপক গুরুত্ব বহন করে থাকে। কবি বা সাহিত্যিকগণ কাব্য, উপন্যাস বা অন্যান্য সাহিত্যকর্মের নাম বা শিরোনাম নির্ধারণের ক্ষেত্রে সাহিত্যকর্মটির অন্তর্নিহিত তাৎপর্য, রূপক বা প্রতীকধর্মিতা, তার জীবন দৃষ্টি প্রভৃতির আলোকে সাহিত্যকর্মের নামকরণ করে থাকেন।
জগদীশ গুপ্তের অসাধু সিদ্ধার্থ উপন্যাসটিতে নটবর নামের এক যুবকের সিদ্ধার্থ বসু ছদ্মনাম ধারণ, প্রান্তিক পর্যায় থেকে কেন্দ্রীয় পর্যায়ে তার ওঠে আসা, মিথ্যার জন্য অনুশোচনা, জীবনের উত্থানপতন ও সামাজিক বিভিন্ন প্রতিবন্ধিতার চিত্র গভীরভাবে বিশ্লেষণ করে উপন্যাসটিকে পরিণতির দিকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।
উপন্যাসের পূর্বকথনে নটবর বা ছদ্মবেশী সিদ্ধার্থ সম্পর্কে বলা
হয়েছে।' সমাজের নিম্নস্তরে তার জন্ম বেড়ে উঠা। কিন্তু সে
নিয়তির বিধান সহজে মেনে নিতে চায়নি, যদিও একটা সময়
তাকে নিয়তির কাছে পরাজয় স্বীকার করে নিতে হয়। নটবর
সম্পর্কে বলা হয়, সে বৈষ্ণবীয় গর্ভে এক ব্রাহ্মণের জারজ সন্তান, দোকানের বিনি পয়সার চাকর, শখের থিয়েটারের ছোকরা অভিনেতা, টাকার বিনিময়ে এক বৃদ্ধ বেশ্যার শয্যাসহচর।
কিন্তু একটা সময় সে নিজের এসব পরিচয়ে পরিচিত হতে চায়নি। তাইতো সমাজের উচ্চাসনে বসতে সে সিদ্ধার্থ বসুর নাম ধারণ করে। কিন্তু সিদ্ধার্থ বসু নাম ধারণ করেও নিজেকে পুরোপুরি শুদ্ধ করতে পারেনি, সে অজয়াকে ভালোবেসেও তার সাথে প্রতারণা করেছে। আবার দেবরাজের সাথে মিলে অবৈধ উপায়ে টাকা উপার্জন করে। আসলে সে সত্যবাদীর মুখোশ পরিধান করে সমাজের মানুষের সামনে সিদ্ধার্থরূপে ছিল কিন্তু মনের কলুষতা পুরোপুরি দূর করতে পারেনি। যার ফলে সে সিদ্ধার্থ হয়ে উঠতে চাইলেও সিদ্ধার্থ হয়ে উঠতে পারেনি। সে তার ভেতর-বাহিরের পার্থক্য নির্ণয়ে সর্বদাই আত্মপীড়ায় ভুগেছে। লেখক সিদ্ধার্থকে উপস্থাপন করেছেন এভাবে, "সিদ্ধার্থের ঋজু বলিষ্ঠ দেহ, বর্ণ গৌর, মুখে বুদ্ধির দীপ্তি, এমনি করিয়া সে পা ফেলিয়া চলে যেন পৃথিবীর যাবতীয় প্রতিকূলতা আর বিমুখতা সে অতীব অবজ্ঞার সহিত দু-পা দিয়া মাড়াইয়া চলিয়াছে। মানুষের সঙ্গ দিয়া, সাহচর্য দিয়া তার কোনো প্রয়োজন নাই, সহানুভূতির সে ধার ধারে না।"
কিন্তু এটা তো সিদ্ধার্থের বাহিরের রূপ। এর ভিতরেও অন্য
একটি রূপ রয়েছে যেটি অপেক্ষাকৃত দুর্বল, পরমুখাপেক্ষী। আর তার এই ভিতরের রূপটি তাকে সব থেকে বেশি তাড়না করে, তাকে সব থেকে বেশি দ্বিধায় ভোগায়। তাইতো লেখক এই চরিত্রটির পরিচয় দিতে গিয়ে তার এই দ্বৈত স্বরূপকে স্পষ্ট করে তুলেছেন। কিন্তু ভিতরটা তার অন্য রকম। কিছুদিন হইতে সেখানে অগ্নিগিরির অগ্নিবমন শুরু হয়ে গেছে। ভিতরে সে শান্ত, অতিশয় পরমুখাপেক্ষী। লেখক সিদ্ধার্থের এই রূপকে আগ্নেয়গিরির সঙ্গে তুলনা করেছেন আর এই তুলনা সিদ্ধার্থের মানসিক অবস্থার মনঃসমীক্ষণের দৃষ্টিভঙ্গি গুরুত্বপূর্ণ। আগ্নেয়গিরিকে সাধারণ অবস্থায় শান্ত এবং নিরুত্তাপ বলেই মনে হয়, কিন্তু তার আগ্নেয় বিক্রম চাপা থাকে অভ্যন্তরে। মানুষের মনের সচেতন অংশ সাধারণত শান্ত ও স্বাভাবিক। কিন্তু অবচেতন বা নিজ্ঞান স্তরে রয়েছে অবদমিত অসামাজিক আকাঙ্ক্ষাগুলো। মাঝে মাঝে বাহিরের কোনো ঘটনার প্রভাবে মানবচিত্তের অবদমিত অসামাজিক স্তর সচেতন অংশকে নিয়ন্ত্রণ করে। যার ফলে দুটি অংশের পারস্পরিক সংঘর্ষে মানসিক বিপর্যয়ের সৃষ্টি হয়। আর সিদ্ধার্থের মধ্যেও এই অস্থির অবস্থা বিশেষভাবে লক্ষ করা যায়। যার ফলে কখনো কখনো সে নিজের অতীতকে ভুলে গিয়ে সামাজিক চিন্তার দ্বারা প্রভাবিত হয়ে সর্বপ্রকার অন্যায় কাজ থেকে বিরত থাকে এবং ঘৃণা করে কিন্তু এই অবস্থা সর্বদাই স্থির থাকে না।
তাইতো তাকে কখনো কখনো জালিয়াতি করা বা প্রতারণা করার
ঘটনার সাথে জড়িত থাকতে দেখা যায়। এতে সে আর সিদ্ধার্থ হয়ে উঠতে পারে না। তার চিত্তের অসাধু অংশ তাকে প্রকৃত সিদ্ধার্থ হয়ে উঠতে দেয় না। আর জগদীশ গুপ্তের কথাসাহিত্যে এভাবে মানুষের নীচতা প্রকাশ পেয়েছে। তিনি ভোগ-তৃষ্ণার কাছে পরাজিত মানুষের বীভৎস প্রকৃতি তুলে ধরেছেন বিস্ময়কর নিরাবেগে এবং মানবপ্রকৃতি যে পোশাকের অন্তরালে নিয়তই এই অশুচি ভাবনার কাছে কোনো না কোনোভাবে পরাভূত, জগদীশ গুপ্ত সেই পরাজিত মানুষ আলোচ্য রচনাতেই বিচক্ষণতা দেখিয়েছেন।
সিদ্ধার্থ কখনো নিজের মনের মধ্যে দৃঢ়-স্থির ভাব আনয়ন করতে পারেনি। যা তাকে পীড়া দিয়ে আবার সমাজের উচ্চস্তরে অবস্থান করেও যা তাকে নিঃসঙ্গ করে দিয়েছে। যার ফলে তার হৃদয়ের মিথ্যা সে কাউকে বলতে পারেনি কিন্তু আচার আচরণ বা কথাবার্তার মাধ্যমে ইঙ্গিত দিয়েছে। নিজের মনের এই অন্ধকার দিকটি সে নিজেই ব্যাখ্যা করেছে, "তাই দেবরাজ ফিক ফিক করিয়া হাসিতে হাসিতে বলিল- অন্ধকার কোথায়? দিব্যি দিনের মতো ফুটফুটে জ্যোৎছনা। -বাইরে নয় ভাই, ভিতরে। -বলিয়া অনিচ্ছুক দেবরাজের ডান হাতখানা বুকের উপর টানিয়া তুলিয়া লইয়া সিদ্ধার্থ বলিল, -অন্ধকার এইখানে।"
এই অন্ধকারের ব্যাখ্যার মধ্যেই আমরা সিদ্ধার্থের অপরাধবোধের স্পষ্ট আত্মপ্রকাশ দেখতে পাই। প্রথমদিকে অপরাধের প্রতিক্রিয়ার
যন্ত্রণা তীব্র হয়ে উঠলেও অপরাধ সম্পর্কে স্বীকৃতি নেই। এখানে সিদ্ধার্থ বলেছে, "কান পেতে থাকো, একটা শব্দ শুনতে পাবে। ভগবানের অভিসম্পাত বুকের গহ্বর জুড়ে চেপে বসে আছে; তার ভেতর থেকে অবিশ্রান্ত উঠছে পৃথিবীর ক্ষুধার গোঙানি।"
এসব ভাবনায় ভাবুক হয়েও সে তার মন থেকে ছলচাতুরী বা প্রতারণা একেবারে দূরীভূত করতে পারেনি। একটা সময় মানসিক যন্ত্রণায় বিপর্যস্ত হয়ে পানিতে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহননের চেষ্টা করে কিন্তু অজয়া নামের একটামাত্র নারীর কারণে সে আত্মহননের সিদ্ধান্ত থেকে দূরে সরে আসে, এই অজয়াই তাকে সবকিছু নতুন করে শুরু করে নতুনভাবে বেঁচে থাকার তাগিদ অনুভব করায়। লেখকের ভাষায়- কিন্তু এসব দ্বন্দ্ব-সংঘাতের মধ্যেও অজয়ার সান্নিধ্য সিদ্ধার্থের নিকট দুর্ভাবনাহীন কতকগুলো নিটোল মুহূর্ত। ফলে লেখক এ সময়ে সিদ্ধার্থের যে মানস পরিচয় তুলে ধরে তা হলো, "ব্যূহ রচনা করিতে হইবে। এই নারী পৃথিবীর উপর মাত্র পা- দুখানা রাখিয়া দাঁড়াইয়া আছে। অন্তর তার গূঢ়ান্বেষী কল্পলোকে সে ফুল ফুটাইতেছে চোখে স্বপ্ন কুহেলিকা, মনে অহমিকা, তাহার সম্মুখে স্পষ্ট হইয়া দাঁড়াইতে হইবে।" কিন্তু অজয়ার প্রতি প্রণয়াসক্তির পেছনেও সিদ্ধার্থের স্বার্থান্বেষী মনোভাব লুক্কায়িত ছিল। সে অজয়াকে ভালোবেসেছিল ঠিকই কিন্তু অজয়ার অর্থসম্পদের প্রতিও তার ছিল লোলুপ দৃষ্টি যার ফলে সে তার মনের চাতুরী একেবারে দমাতে পারেনি। আর লেখক বারবার তার মনের এই অন্ধকার দিকের প্রতি দৃষ্টি দিয়েছেন। দেবরাজের দেওয়া জালিয়াতির প্রস্তাব সে প্রথমদিকে গ্রহণ করতে ইচ্ছা পোষণ না - করলেও পরবর্তীকালে পরিস্থিতির কারণে এই অনৈতিক প্রস্তাব গ্রহণ করেছে। হয়তো তার কাছে বিকল্প উপায়ও ছিল কিন্তু সে বিকল্প উপায় অবলম্বন না করে তার প্রতারক স্বভাবের প্রমাণ দিয়েছে।
একটা সময় যখন তার এসব ছদ্মবেশী স্বভাব সকলের কাছে ধরা পড়ে যায় এবং অজয়ার কর্ণগোচর হয় তখন অজয়াকেও সে নিজের করে পায় না। লেখক এখানে ক্ষণিক বিদ্রূপ প্রকাশ করেছেন। কেননা যে অজয়ার জন্য সিদ্ধার্থ নতুনভাবে বেঁচে থাকার স্বপ্ন বুনেছিল। একদিন তার ছদ্মবেশী স্বভাব অজয়ার কাছে ধরা পড়ে যায়। তাইতো তাকে বাধ্য হয়ে সবকিছু ত্যাগ করে, সবাইকে ছেড়ে একদিন চলে যেতে হয়। অথচ সিদ্ধার্থের কূটকৌশলের কারণে এই অজয়া একদিন তাকে ভালোবাসতে বাধ্য হয়েছিল। সে এভাবেই সমাজে সাধুর আসনে বারবার তার অসাধু স্বভাবের প্রমাণ দিয়েছে।
উপন্যাসটি থেকে স্পষ্টভাবে বুঝা যায়, লেখক নটবর নামক যুবককে পুরোপুরি সিদ্ধার্থ হতে দেননি। সিদ্ধার্থ তার আচরণে বারবার তার অতীত ইতিহাসের সাক্ষ্য দিয়েছে। সে তার প্রতারণা, প্রবঞ্চনা, কবিতা দ্বারা মানুষের মনে নটবর হিসেবেই স্থান করে নিয়েছে, চেষ্টা করেও সিদ্ধার্থ হয়ে উঠতে পারেনি। তাই দেখা যাচ্ছে, উপন্যাসটির নামকরণের যথেষ্ট ভূমিকা রয়েছে, লেখক কাহিনি অবলম্বনে উপন্যাসটির সার্থক নামকরণে সক্ষম হয়েছেন।