অসাধু সিদ্ধার্থ উপন্যাসে বিধৃত সমাজবাস্তবতার স্বরূপ পর্যালোচনা কর।
বাংলা সাহিত্যে ব্যতিক্রমী কথাসাহিত্যিক জগদীশ গুপ্ত (১৮৮৬-১৯৫৭)। তার সাহিত্যে মানবজীবনের অন্ধকারময় কদর্য রূপ নানাভাবে উঠে এসেছে। তিনি মানবমনের গহিনের পাপবোধ এবং কদর্যমেশানো রূপকে শৈল্পিক দক্ষতায় উপস্থাপন করেছেন। তার কথাসাহিত্যে ভাগ্যহীন মানুষের হতাশা, বেদনা, অসহায়ত্ব ও ব্যর্থতা নানাভাবে উঠে এসেছে। তিনি 'কল্লোল', 'কালি-কলম' প্রভৃতি পত্রিকায় নিয়মিত লিখলেও তার রচনায় এসব গোষ্ঠীর কোনো ভাবধারা প্রকাশিত হয়নি।
তিরিশোত্তর বাংলা কথাসাহিত্যের উপাদান-বিষয় ও বিন্যাসকুশলতায় বিশিষ্ট যে মাত্রা যোগ করেছেন, তা যুগপৎ অপূর্ব ও অনন্য। যে জীবনবীক্ষা রূপ ও রসে তার রচনায় চাবুকৃত, তা তার স্বোপার্জিত। গল্প কিংবা উপন্যাসে পূর্বাপর তিনি সংযুক্ত অভিন্ন অভিপ্রায়। বাংলাদেশে' তার আবির্ভাব অবাঞ্ছিত নয়; কেননা এই আবির্ভাবের পটভূমি প্রস্তুত করেছে সময় ও সমাজ।
জগদীশ গুপ্তের কথাসাহিত্যে মানুষের মন, মৌনতা, বিশ্বাস, অভ্যাস, প্রবণতা ও আচরণের নানা দিক উন্মোচিত হয়েছে। সুন্দর মুখের আড়ালে মানুষের মুখোশের বিকৃত ছবি তার কথাসাহিত্যে প্রাণ সঞ্চার করেছে। তার সম্পর্কে আবুল আহসান চৌধুরী বলেছেন, "রবীন্দ্রনাথ- শরৎচন্দ্র বাংলা কথাসাহিত্যের যে আদর্শ নির্মাণ করেছিলেন, উত্তরপর্বে সেই বুচি, রূপ, রীতি ও বিশ্বাসকে অগ্রাহ্য ও বিচূর্ণ করে কথাসাহিত্যে যে পালাবদল এসেছিল, এক ভিন্ন অর্থে জগদীশ গুপ্ত ছিলেন তার প্রধান ঋত্বিক। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ঘটনার কার্যকারণ সূত্রে পরিবর্তিত আর্থ-সামাজিক কাঠামোর অন্তর্গত সংকট ও সমস্যার পরিপ্রেক্ষিতে জীবন-অন্বেষা ও সমাজ-বাস্তবতার যে শিল্পভুবন নির্মিত হয়েছিল, তিনিই ছিলেন তার উদ্বোধক ও শ্রেষ্ঠ প্রতিনিধি।"
লেখক তার সমকালীন সাহিত্যিক পরিমণ্ডল থেকে দূরে অবস্থান করেছেন। পত্র-পত্রিকাকেন্দ্রিক আড্ডা বা মজলিসেই শুধু নয়, বাস্তবতাজাত ব্যক্তিঅসংগতির কথা কোবিন আণুবীক্ষণিক অনুসন্ধানেও তার রচনায় রোমান্টিক চেতনা আবিষ্কার করা সম্ভব।
জগদীশ গুপ্তের অসাধু সিদ্ধার্থ উপন্যাসে (১৯২৯) আমরা অভাবের প্রাচুর্য লক্ষ করি। এই অভাব শুধু ক্ষুধানিবৃত্তির নয়। এর পাশাপাশি সুসময়, আশা, আলো, উত্তরণ-বিশ্বাস ইত্যাদি। অভাবের দিকটি ঔপন্যাসিক শৈল্পিক ভঙ্গিমায় তুলে ধরেছেন। মোটকথা সামাজিক প্রতিকূলতা ও প্রবৃত্তির তাড়নার পরিণামে ব্যক্তিমানুষের আত্মিক পরাজয়কে তিনি উপস্থাপন করেছেন। উপন্যাসের নটবর সামাজিক প্রান্তিকতা থেকে কেন্দ্রের অভিমুখে যাত্রা করলেও ভণিতা থাকায় সফলতা আসেনি। নটবরের সিদ্ধার্থ হয়ে ওঠার অবরুদ্ধ প্রয়াস এবং একসময়ে তার ব্যর্থতা সামাজিক নিয়মনীতি-প্রতিবন্ধকতার মূলেই সমর্পিত। অসাধু সিদ্ধার্থ উপন্যাসে প্রচলিত রীতির অনেক ঘটনাই ঔপন্যাসিক সমাজবাস্তবতার আলোকে সামনে নিয়ে এসেছেন। অভাবের তাড়নায় জাল করা, ঋণের জ্বালায় আত্মহত্যার চেষ্টা, নায়িকার আবির্ভাব, দেখামাত্র = প্রেম, ফুলের তোড়া ছুড়ে প্রেম নিবেদন, নায়িকার ভাইকে বিপদ থেকে উদ্ধার কিন্তু এসবের প্রত্যেকটি ঘটনাকে তিনি আপাত গ্রহণ ও করেছেন। লেখকের নিজের কথা বুঝাবার জন্য যে, মানুষের - একই চেষ্টিত উল্টো পিঠে আর এক বিপরীত জিনিস রূপ পেতে ■ থাকে। তিনি শুভবাদী নন, অশুভবাদীও নন, পরিষ্কার অর্থেই সমাজবাদী-জীবনবাদী, পাপ-পুণ্য দুটিকেই তিনি অস্বীকার করেছেন এজন্য যে, কোনোটির কোনো চরম মূল্য নেই; আবার স্বীকার করেছেন এই ভেবে যে, আপেক্ষিক মূল্যেও দুটিই জীবনে জড়িয়ে রয়েছে। সিদ্ধার্থকে মনে হয়, প্রতি মুহূর্তে সে অভিনয় করে চলেছে, তার সুখের এবং দুঃখেরও, ভালো করাটাও তার ভালো করা নয়, মন্দটাও যেন ঠিক মন্দ নয়, সে আর একটা কিছুর প্রক্সি দিয়ে চলেছে।
জগদীশ গুপ্ত মনে করেন, সামাজিক মূল দুর্নীতির মূল কারণ অসংযত কামনা এবং স্বার্থচিন্তা। এই চিন্তা থেকে মুক্ত হতে না পারলে অবস্থার উত্তরণ সম্ভব নয়। ঔপন্যাসিক উপন্যাসের শুরুতে জানিয়েছেন সুদের কারবারির চিত্র। এই সুদ-ব্যবসায়ের প্রতিনিধি রাসবিহারী। রাসবিহারী তার শত্রুকে সর্বস্বান্ত করতে চাওয়ার মধ্যেই অবক্ষয়িত একটি সমাজের পরিচয়ই পাওয়া যায়। আবার এসব চরিত্রের মাধ্যমে লেখক সামাজিক বিশ্বাসকেও ফুটিয়ে তুলেছেন- "সকলের আগে গিয়েছেন লক্ষ্মী।" এছাড়া লেখক উপন্যাসে চাষের জমি, বসতভিটা, পূজামন্দির, অনাথ-জারজ শিশু, সমাজপতি, থানা-পুলিশ, বিয়ে-সাদি, জমিদার শ্রেণির কথা তুলে ধরার কারণে সে কালের সমাজচিত্রই উজ্জ্বল হয়েছে।
গ্রামের মানুষের মধ্যে দলাদলি, কারণে-অকারণে একজন আরেকজনকে ক্ষতি করার জন্য উঠেপড়ে লাগার চিত্রও লেখক রাসবিহারী চরিত্র অঙ্কনের মাধ্যমে ফুটিয়ে তুলেছেন। যেমন- "সর্বনাশ করবো ব'লে কোমর বেঁধেছি যদি জানো তবে টাকা দেখাচ্ছ কেন? টাকা আমার ঢের আছে- ব'য়ে ব'য়ে টাক পড়ে গেছে। আর তুমি যে টাকার কথা শোনাচ্ছ সে টাকা কাকে রাজা ক'রে দিয়ে বখশিস পেয়েছে, শুনি?"
তাছাড়া এ উপন্যাসের গ্রামের সাধারণ মানুষের আচার ব্যবহারের পরিচয়ও লেখক অঙ্কন করেছেন। অজয়ার বিয়ে স্থির হলে রজত হেমন্তপুরে সাধুচরণ দাসের কাছে তথ্য আনতে যায়। রজত তথ্যের বিনিময়ে সাধুচরণকে টাকা দিতে গেলে যে অবস্থার সৃষ্টি হয় তা ঐ কালেরই সমাজচিত্রেরই বহিঃপ্রকাশ ঘটে। যেমন- "রজত শহরের মানুষ, কাজ করাইয়া লইয়া পয়সা দেওয়ার অভ্যাস আছে। কিন্তু সাধুচরণের লওয়ার অভ্যাস নাই। টাকাটা রজত দিতে গেলেই সাধুচরণ বিস্মিত হইয়া বলিল- টাকা কেন, বাবু!
-তোমাদের কষ্ট দিলাম, মিষ্ট খেও।
- না, বাবু, দুটো কথা ক'য়ে মিষ্টি খেতে টাকা আমি নিতে পারবো না- আপনি ও রাখুন, বরঞ্চ যদি অনুমতি করেন ত... আপনার আহারাদির যোগাড় ক'রে দিই। এ বেলা সেবা ক'রে ও বেলা গাড়ী ধরবেন।"
আগের যুগের সমাজের মানুষের যে অভিজ্ঞতা তা পিসিমা এবং মাতামহ কাশীনাথের উক্তিতে লেখক বারবার তুলে ধরেছেন। সমাজ মানুষকে যে শিক্ষা দেয় তা যে আর কোথাও থেকে লাভ করা সম্ভব নয়- এমনই ইঙ্গিত জগদীশ গুপ্তের-
পিসিমা বলিলেন, প্রথম যেদিন দেখা হ'ল সেদিন আমি একা ছিলাম। সিদ্ধার্থ ঘরে ঢুকতেই আমার চোখে পড়ল তার চোরের দৃষ্টি।... অভ্যস্ত চতুর দৃষ্টি- যা একপলকেই দেখে নেয়, কোথায় কোন জিনিসটা রাখা আছে, কোনটা ভারি, কোনটা হালকা-
প্রত্যেকটির মূল্য কত!"
উপন্যাসে প্রচলিত সমাজের লোকবিশ্বাসের কথা ব্যক্ত হয়েছে। ননীর সঙ্গে কথা বলার সময় অজয়া জানিয়েছে যে তার বাঁ চোখ নাচছে। তখন ননী বলে, "বাম অক্ষের কাঁপুনি আমাদের পক্ষে শুভ আর পুরুষের পক্ষে অশুভ সূচনা করে। তোমার সু-খবর বুঝি দাদাবাবুই আনছে।” এরপরেই অসদুদ্দেশ্যে সিদ্ধার্থ অজয়াদের পরিবারের বৃত্ত অন্তর্গত হতে চায়। অর্থাৎ মহিলাদের বাঁ চোখ নাচা সবসময় শুভ নয়। তবে শেষ পর্যন্ত অজয়া সিদ্ধার্থের কাছে বৃহত্তর প্রতারণার হাত থেকে বেঁচে যায়। এদিক থেকে অজয়ার ভালোই হয়েছে। তাই তার বাঁ চোখ নাচার বিষয়টিকে ভালো- মন্দ দুই-ই ওতপ্রোত হয়ে আছে, এ উপন্যাসে তির্যক ভাষায় সমাজ- মানবচরিত্র এবং লোকবিশ্বাস সম্পর্কে তীব্র চপেটাঘাত করা হয়েছে। সব সমাজেই যে কমবেশি অলৌকিক-অতিলৌকিক কল্পকাহিনি, ভূত-প্রেতে বিশ্বাস আছে তা এ উপন্যাসেও ব্যক্ত হয়েছে। যেমন- "সেই অন্ধকারের ভেতর জেগে ঝকঝক করছিল শুধু নরকঙ্কাল আর প্রেতের দল সারিবেঁধে শোকযাত্রায় বেরিয়েছিল- তাদের অট্টহাসির শব্দ যেন কানের গা ঘেঁষে করতালি বাজাচ্ছিল।"
ঔপন্যাসিক উপন্যাসের শুরুতে নটবরের কথা তুলে ধরেছেন। সেখানে নটবরের পরিচয় তুলে ধরে দেখানো হয়েছে যে, জারজ সন্তান নটবর জীবনের কাছে পরাজয় স্বীকার করেনি। জারজ সন্তান বলেই সমাজ তাকে এমন অবস্থায় নিপতিত করেছিল যে, তাকে চোর-জোচ্চোরদের সাথেই অসামাজিকভাবে বেঁচে থাকতে হবে। এ সমাজ তাকে অপাঙ্ক্তেয় করে নটবরের জীবনকেই বিষিয়ে তুলেছে। যেমন- "সিদ্ধার্থ গৃহী নয়, গৃহ তার নাই, বৈরাগী সে নহে, বৈরাগী তার জন্মে নাই মাঝখানে সে দুলিতেছে... ইহা যে কতবড় ব্যর্থতা, বিরহ আর শূন্যতা তাহা কেবল সেই জানে যার ঘটিয়াছে।"
ঔপন্যাসিক জটিল মানবমনের গহিনে প্রবেশ করে অন্ধকার রূপটি তুলে ধরার সাথে সাথে সমাজ-পরিবেশও যেন প্রকাশ পেতে থাকে। প্রথাগত সমাজের ধারণায় অনৈতিকভাবে নটবরের জন্ম। মানুষ হয়েছে সেভাবেই। তাই তার আচার-আচরণে অনাকাঙ্ক্ষিত রূপ ফুটে ওঠা স্বাভাবিক। লেখকের চোখে নটবর পাপী শয়তানও নয়, আবার তার স্নেহাশিত মানসপুত্রও নয়। সে সমাজেও বারবনিতা প্রথা ছিল তা প্রকৃত সিদ্ধার্থের পিতামহ কাশীনাথের জবানিতে প্রকাশ পেয়েছে। "পরিচয় দেয়া এখনো শেষ হয়নি। এক বৃদ্ধা বেশ্যার শয্যাচর ছিল, অর্থলোভে ও তার পরিচর্যা করতো।"
জগদীশ গুপ্ত যে জগৎ থেকে ঘটনা ও চরিত্র গ্রহণ করেছেন, সে জগতের মানুষ শোষিত-অবহেলিত-প্রতারিত সমাজেরই ভগ্নাংশ। এ সমাজের মানুষ সুসংগঠিত নয় পরস্পর বিচ্ছিন্ন, নিঃসঙ্গ আত্মগুহাবাসী, অভিশপ্ত বংশগতিযুক্ত। সমাজের মূল স্রোতে অন্তর্ভুক্ত হবার প্রবল তাগিদে সিদ্ধার্থ বসুর পরিচয় আত্মসাৎ করেও সে দলিল জালিয়াতির মতো অপরাধের সঙ্গেও সম্পৃক্ত হয়। সিদ্ধার্থ নিশ্চয়ই জানত সে সিদ্ধার্থ নয় নটবর, সিদ্ধার্থ তার ভুল স্বর্গ, অলীক আদর্শ, আত্ম প্রতারক কল্পনা। কিন্তু এটা অস্বীকার করা যায় না যে, নটবর আসলে সিদ্ধার্থই হয়ে উঠতে সর্বাত্মক চেষ্টা করেছে।
সিদ্ধার্থ রজতকে প্রতারণা করতে সক্ষম হয়েছে- অজয়াকে কূটকৌশলে তাকে ভালোবাসতে বাধ্য করেছে। তাই সিদ্ধার্থ প্রতারক-অসাধু। প্রান্তিক পর্যায়ে পৌঁছে নটবরের সব পরিকল্পনা ধরা পড়ে যায়। বিবাহবন্ধনের ঠিক পূর্বে অজয়া সিদ্ধার্থের প্রকৃত পরিচয় জেনে যায়। কাশীনাথ কোনোকিছুই না লুকিয়ে অকপটে সিদ্ধার্থের ক্লেদাক্ত সব অতীত প্রকাশ করে। তার ভাষায়-
"তোমরা সিদ্ধার্থ বলছ কাকে? ওর নাম নটবর, বৈষ্ণবীর গর্ভে এক ব্রাহ্মণের জারজপুত্র ও... পরিচয় দেয়া এখনো শেষ হয়নি। এক বৃদ্ধা বেশ্যার শয্যাচর ছিল, অর্থলোভে ও তার পরিচর্যা করতো।"
সিদ্ধার্থ নামধারী সুদর্শন যুবকটি মুহূর্তে নটবর হয়ে যায়; সে পিতামহের কোনো কথা অস্বীকার করেনি। কোত্থেকে যে সে সিদ্ধার্থের নাম আর পরিচয় পেল, এই প্রশ্নেরও কোনো উত্তরও সে দেয়নি। সব অপমান সহ্য করে সে নিরুদ্দেশে বেরিয়ে পড়ে। কোথায় যাবে তাও পাঠককে বলা হয় না। শুধু সে চলে যাচ্ছে দেখে পিতামহ লাফিয়ে উঠে জিজ্ঞাসা করেন- "ব'লে যা শয়তান, আমার সিদ্ধার্থ কোথায়? -কোথায় তা জানিনে, স্বর্গ কি নরকে; তবে সে বেঁচে নেই?- বেঁচে নেই। নটবর যাইতে যাইতে মুখ না ফিরাইয়াই বলিয়া গেল- না।"
জগদীশ গুপ্তের রচনায় জগৎ ও মানুষের প্রতি অন্ধবিশ্বাস
অবাস্তব, আবার জীবন্ত মানুষের প্রতি মানুষের মানবিক সম্পর্কের
বিশ্বাসহীনতায় বাস্তব। বাস্তব ও অবাস্তব জগতের কথা তুলে
ধরতে গিয়ে সমাজবাস্তবতাই যেন সামনে উঁকি দিয়েছে। অজয়ার
সান্নিধ্যে নটবর আত্মহত্যার মুখ থেকে নিজেকে বিরত রাখে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত যখন কাশীনাথের উপস্থিতিতে অজয়াকে বিয়ের শেষ মুহূর্তে সিদ্ধার্থের মুখোশ খসে পড়ে- তখন সে শামুকের মতো নিজেকে গুটিয়ে নিয়ে বলেছে-
"আমি নিরপরাধ। নিয়তির চক্রান্তে ভালোবেসেছিলাম। ভালোবাসার তাড়নায় আর প্রতিদানের লোভে মিথ্যার আশ্রয় নিয়েছি। কিন্তু আমি ত' সেই মানুষ।" পিতৃপরিচয়হীন হওয়ায় ছোটবেলা
থেকেই যেন তার ভাগ্য নির্ধারিত হয়ে গিয়েছিল। তাকে বসবাস করতে হবে সমাজের অন্ত্যজশ্রেণির মানুষের সঙ্গে। তাদের সঙ্গে থেকে অসামাজিক কাজের সঙ্গে যুক্ত থাকতে হয়েছে। কিন্তু এই অবস্থা থেকে উত্তরণে নটবরের প্রয়াসের অন্ত ছিল না। এজন্য তার প্রেমের সম্পর্ক হয়েছিল ভদ্রকন্যার সঙ্গে। কিন্তু শেষ মুহূর্তে তার চরিত্রের উন্মোচন সবকিছু উলট-পালট করে দেয়। এভাবে নটবর থেকে সিদ্ধার্থ হয়ে যাওয়া একটি স্বপ্নের মৃত্যু ঘটে।
উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, জগদীশ গুপ্তের 'অসাধু সিদ্ধার্থ' উপন্যাসে সমাজ এক মানবজীবনের বিচিত্র দিক, বিশেষ করে আচরণের আড়ালের যে অন্ধকারাচ্ছন্ন কুটিল মানুষ তাদের অন্তর্গত খলতা-কৃরতা, নিষ্ঠুরতা-কামুকতা- পাপাচার প্রভৃতি তুলে আনতে গিয়ে নিজের মতো করে একটি জীবনভাষ্য রচনা করেছেন আর তাতেই সমাজের পরিচয়টিও স্পষ্ট হয়েছে।