আবার কখনো জেগে রয় রাতে একা বাঁকা চাঁদ পশ্চিমেতে, রাতের নদীতে আরো জেগে রয় আঁকাবাঁকা চাঁদ জলের নিচে, পশ্চিম- ভরা আকাশ ফাঁকা।
আলোচ্য অংশটুকু ত্রিশোত্তর ধারার কবি বুদ্ধদেব বসুর কঙ্কাবতী কাব্যের কঙ্কাবতী কবিতা থেকে চয়ন করা হয়েছে। প্রকৃতিতে এবং কবির হৃদয়রাজ্যে কঙ্কাবতী নামটি যে প্রভাব ফেলেছে তা এখানে প্রকাশ পেয়েছে।
এ কবিতায় কবির প্রিয়া কঙ্কাবতীকে কেন্দ্র করেই পরিভ্রমণ করে কবির সব কল্পনা। কবি উপমার পর উপমা সাজিয়ে কঙ্কাবতীর অস্তিত্ব-অনুভবকে শৈল্পিকভাবে প্রকাশ করেছেন। শুধু বায়বীয় অস্তিত্ব কল্পনাই কঙ্কাবতীর রূপরেখা নয়। স্বাদ-গন্ধ-স্পর্শ সহকারেও কঙ্কাবতী উপস্থিতি এ কবিতায়। মাঝরাতে বাতাস হিল্লোলিত, আঁধার ধরনি, যামিনী নিঝুম হয়েছে, এলোমেলো ব্যাকুল হয়েছে বাতাস, রাঙা ভাঙা চাঁদ কঙ্কাবতীর জন্যই যেন উঠেছে। রজনী নীড়ে ঘুমের পাখিরা জেগে উঠেছে কিন্তু কঙ্কাবতী ঘুমিয়ে আছে। হাওয়ার আওয়াজ দিন-রাত, সারারাত গান গেয়ে যায় কঙ্কাবতীর নামে 'কঙ্কাবতী গো!'। কবির মনের অপার আকাশে হাজার হাজার প্রতিধ্বনি; ডানে-বামে, উপরে-নিচে একই প্রতিধ্বনি 'কঙ্কা', 'কঙ্কা' এমনকি রাতের ঘুমের নীরব সময়ও কঙ্কাবতীর নামে গান গেয়ে যায়। প্রতিটি মুহূর্ত ফুটে ওঠে ফুলের মতো- সেটাও কঙ্কাবতীর নামে। রাতের ঘুমের প্রতি মুহূর্তে কঙ্কাবতীর নামে সুখ উপলব্ধি হয়। কবির ঘুমের সময়েও কাজের জোয়ারে কে যেন ডেকে যায়, কঙ্কা! কঙ্কা! রবে। মাঝরাতে দেখা যায় আকাশের বুকে ঝঝকে তারা মিটমিট করে জ্বলে-আলোর পোকা আকাশ কোমল তাদেরই প্রতিচ্ছবি। কঙ্কাবতীর নামের শব্দের সুর তারারাও সেন জানে-সেই সুরেও তারাও ঘুরে ঘুরে নাচে। একশো কোটি তারা আকাশের বুকে কঙ্কাবতীর নামে। কবির মনের কঙ্কাবতীর নামের শব্দ আকাশে তারার মতোই-ফুটে থাকে একশো কোটি নাম "কঙ্কাবতী" গো! আবার তা কখনো পশ্চিমের আকাশে রাতে একা বাঁকা চাঁদ জেগে থাকে। এমনকি রাতের নদীতে, আঁকাবাঁকা চাঁদের সাথে জলের নিচেও কবির নায়িকা কঙ্কাবতী নামটি জেগে থাকে। কবি এই কবিতায় বাংলার প্রাচীন লোকনায়িক কঙ্কাবতীর প্রতি প্রবল ভালোবাসার আকর্ষণ বহন করেন নৈসর্গিকভাবে। কঙ্কাবতী অনিন্দ্য প্রেমিকা হয়ে বুদ্ধদেব বসুর কাব্যতে বিচরণ করে আনন্দচিত্তে। কঙ্কাবতী কবিতায় কবি কঙ্কাবতীর জন্য আকুলপ্রায়। কঙ্কাবতীর জন্য সে অধীর প্রতীক্ষায় কাতর। কঙ্কাবতীর প্রতি অন্তরঙ্গ মুহূর্তের কথা কবিচিত্তে বারবার দোলা দেয় প্রত্নপ্রজ্ঞায়। কঙ্কাবতী কবিতায় কবি তার সুপ্রিয়া প্রেমিকা মুখ তোলা মাত্র কবি হারিয়ে ফেলেন ওই সৌন্দর্যময় বাক্যগুলো, যা বলার জন্য অপেক্ষায় ছিলেন কবি দীর্ঘদিন।
পরিশেষে বলা যায় যে, কবির হৃদয়বীনায় কঙ্কাবতীর নামটি একান্ত হয়ে আছে; শুধু তাই নয়- সেই নামটি কবি প্রকৃতির মধ্যে খুঁজে পান-একথাই কবি চরণগুলোতে প্রকাশ করেছেন।